টুলু ভাষা
টুলু ভাষা হলো দ্রাবিড় ভাষগোষ্ঠীর দক্ষিণ দ্রাবিড় শাখার একটি বিপন্ন ভাষা যা মূলত ভারতের কর্ণাটকের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের দুটি সমুদ্র তীরবর্তী জেলায় প্রচলিত। কর্ণাটকের দক্ষিণ কন্নড় জেলা এবং উদুপি জেলা এবং কেরলের কাশাড়াগার জেলার একটি নির্দিষ্ট অংশে এই জনজাতির মানুষের আদি বাসস্থান। পশ্চিমবঙ্গের কোনো নির্দিষ্ট জেলায় ঘনসংঘবদ্ধভাবে এই জনজাতি বাস না করলেও রাজধানী শহর কলকাতায় বিচ্ছিন্নভাবে এই জনজাতির মানুষ বসবাস করেন, যাদের মূলত জীবিকার প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গে আগমন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষায় কথা বলেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫৭৬৩২। এই ভাষায় কন্নড় বা টুলু লিপি লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়।
টুলু ভাষার এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তামিল বা কন্নড় ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষার মতোই ‘প্লিউপারফেক্ট’ বা ‘ফিউচার পারফেক্ট’ ক্রিয়ার কালের অস্তিত্ব আছে যেটি অক্সিলিয়ারি ভার্ব অর্থাৎ সাহায্যকারী ক্রিয়া ছাড়াই গঠিত হয়। এই ভাষার নিজস্ব টুলু লিপির প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে, এই লিপিতে ‘শ্রীভাগবত’ এবং ‘কাবেরী’ নামে সপ্তদশ শতকের দুটি মহাকাব্য রচিত হয়েছিল। তবে বর্তমানে টুলু ভাষায় কন্নড় লিপির ব্যবহার বেশি। টুলু ভাষায় মৌখিক সাহিত্যেরও নিদর্শন রয়েছে; ‘পদ্দন্য’ নামে মহাকাব্যিক কবিতা এই ভাষায় মৌখিকভাবে প্রচলিত। ভাষাতাত্ত্বিক পি গুরুরাজা ভাটের মতানুসারে ‘টুলু’ বা ‘টুলুভা’ শব্দটি ‘টুরুভা’ শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছে; ‘টুরু’ শব্দের অর্থ গরু এবং ‘ভা’ শব্দের অর্থ যাদব জাতির বাসস্থান। ভাষাতাত্ত্বিক পুরুষোত্তম বিলিমাটে এর মত অনুযায়ী ‘টুলু’ শব্দের অর্থ হলো, যা জলের সঙ্গে সংযুক্ত। কন্নড় ভাষাতেও ‘তালিপু’, ‘তেলি’, ‘তেলপু’, ‘তুলিপু’ ইত্যাদি শব্দ পাওয়া যায় যেগুলি জলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। টুলু ভাষা ভারতের সরকারি ভাষাগুলির মধ্যে পড়ে না। এই ভাষার লিপি ‘তিগালারি লিপি’ নামে পরিচিত, যেটির সাহায্যে বেদ এবং অন্যান্য সংস্কৃত শব্দ লেখা হতো। এই লিপিটি ‘গ্রন্থি লিপি’ থেকে ‘ব্রাহ্মী লিপির মাধ্যমে উদ্ভুত হয়েছে। মালায়লম লিপির সাথে এই লিপির সাদৃশ্য রয়েছে। এদের বর্ণমালায় ‘অ’ এবং ‘ও’ ধ্বনির উপর বিশেষ জোর পড়ার প্রবণতা আছে। ‘আউ’, ‘আম’ ‘আহ’ ইত্যাদি ডিপথং এই ভাষায় প্রচলিত। টুলু ভাষার কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে, যথা সেন্ট্রাল টুলু, উত্তর-পশ্চিম টুলু, দক্ষিণ-পশ্চিম টুলু, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব টুলু, দক্ষিণ-মধ্য টুলু ইত্যাদি। এছাড়া ব্রাহ্মণ টুলু, জৈন টুলু এবং গিরিজান টুলু নামে তিন প্রকার টুলুর কথা জানা যায়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ টুলু প্রকারটির উপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব রয়েছে। টুলু ভাষায় অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষার মতোই ৫টি হ্রস্ব এবং ৫টি দীর্ঘ স্বরধ্বনি আছে। যেকোনো ক্রিয়ার উত্তম পুরুষ একবচন এবং প্রথম পুরুষ একবচনের রূপ এই ভাষায় একই হয়। কিন্তু উভয়ক্ষেত্রে উচ্চারণের তারতম্য ঘটে। এই ভাষায় মোট ১৪টি ব্যাঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। শব্দের প্রথমে কোনো ‘কনসোনেণ্ট-ক্লাস্টার’ এর অস্তিত্ব বিরল, এগুলি মূলত সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে আগত শব্দে দেখা যায়। এই ভাষায় ৫ প্রকার ‘পার্টস অফ স্পিচ’ রয়েছে, যথা বিশেষ্য্ সর্বনাম, সংখ্যাবাচক শব্দ, ক্রিয়া ও পার্টিকেল অর্থাৎ নিপাত। এই ভাষায় ৮ প্রকার কারক, তিন প্রকার লিঙ্গ (পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ এবং ক্লীবলিঙ্গ) এবং দুই প্রকার বচন (একবচন ও বহুবচন) রয়েছে। ক্রিয়ার তিনটি রূপ রয়েছে, অ্যাক্টিভ, কজেটিভ ও রিফ্লক্সিভ। লিঙ্গ, বচন, পুরুষ ও ক্রিয়ার কাল অনু্যায়ী ক্রিয়ার রূপের পরিবর্তন ঘটে। ভাষাটির সর্বপ্রথম লিখিত সাহিত্যের নিদর্শন হলো মহাভারত এর অনুবাদ। এটি ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে অরুণাব্জ নামে একজন কবি রচনা করেন। এই ভাষায় প্রায় ১০০০০ প্রবাদ এবং ১০০০ ধাঁধার একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Bhat, S.L. A Grammar of Tulu: a Dravidian Language.
Briegal, J.A. A Grammar of Tulu Language
Census of India 2011
Caldwell, R.A. A Comparative Grammar of the Dravidian or South-Indian family of languages. Longdon: Harrison
Kumar, Shiva. 2020 Tulu Nadu India: A Cultural Guide by a Local