মুন্ডারি ভাষা হলো অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর উত্তর-মুন্ডা শাখার খেরওয়ারী উপশাখার একটি ভাষা। এি ভাষাটি মূলত পূর্ব ভারতের ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমপ্রান্তে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বসবাসকারী মুন্ডা ও ভূমিজ জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। এটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরকারি ভাষা; রাঁচি, খুন্তি, সরাইকেলা, পূর্ব ও পশ্চিম সিংভূম ইত্যাদি জেলায় মুন্ডা জনাধিক্যের কারণে ভাষাটির বহুল প্রচলন রয়েছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে মোট ১৬৬১৬৫৬ জন মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষার নিজস্ব লিপি মুন্ডারি বাণী নামে পরিচিত। এছাড়া ওড়িয়া, দেবনাগরী, বাংলা এবং ল্যাটিন লিপিও লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। হফম্যানের ‘এনস্লাইকোপিডিয়া মুন্ডারিকা’ অনুসারে এই ভাষার প্রচলিত প্রকারগুলির মধ্যে হাঁসদা, নাগুরি, তামারিয়া, কেড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ভূমিজের সঙ্গে মুন্ডারি ভাষা নিকট সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও মনে রাখা প্রয়োজন, ভূমিজ মুন্ডারির কোনো প্রকার নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা। রবার্ট পারকিন এর মতে ‘মুন্ডা’ শব্দটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক অভিধানের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটি একটি সংস্কৃত-জাত শব্দ, যার অর্থ ‘প্রধান ব্যক্তি’ অথবা ‘মোড়ল’।

মুন্ডারি ধ্বনিতত্ত্ব অন্যান্য অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাকে অনুসরণ করলেও ভারতীয়-আর্য ও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই ভাষার স্বরধ্বনির উপর অন্য ভাষার প্রভাব সর্বাধিক। মুন্ডারি ভাষায় মাত্র ৫টি স্বরধ্বনি স্বনিম অর্থাৎ ভাওয়েল ফোনিম বর্তমান। সব স্বরধ্বনিরই দীর্ঘ, হ্রস্ব ও নাসিক্য এলোফোন রয়েছে। কিন্তু স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য ও নাসিক্যিভবন বৈশিষ্ট্য পরস্পর কন্ট্রাস্টিভ নয়। একটিমাত্র অক্ষর অর্থাৎ সিলেবলযুক্ত (মুক্ত) স্বরধ্বনিগুলির দৈর্ঘ্য রুদ্ধ স্বরধ্বনির চেয়ে বেশি। এই ভাষায় ২৩টি ব্যাঞ্জনধ্বনি রয়েছে, যাদের মধ্যে ১০টি স্টপ, ফ্রিকেটিভ, ৫টি ন্যাসাল, এপ্রক্সিমেণ্ট, ৩টি লিকুইড ও ট্রিল প্রকার বর্তমান। এছাড়া নাগুরি ও কেড়া প্রকারের মধ্যে এস্পিরেটেড স্টপ এর অস্তিত্বও রয়েছে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রোহিদাস সিংহ নাগ সর্বপ্রথম মুন্ডারি বাণী নামক লিপিটির প্রচলন করেন যার মধ্যে ২৭টি বর্ণ ও ৫টি ডায়াক্রিটিকের অস্তিত্ব রয়েছে। এই লিপি বামদিক থেকে ডানদিকে লেখা হয়। বর্তমানে মুন্ডারি ভাষা ভারতের একটি সরকারি এবং আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। হাঁসদা প্রকারটিকে মুন্ডারি ভাষার মান্য প্রকার হিসেবে স্বীকার করা হয়। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে হফম্যান এবং ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কুক মুন্ডারি ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাকরণ রচনা করেন। মুন্ডারি ভাষায় মাত্র ৩ প্রকার সিলেবল বাউণ্ডারি বর্তমান, যথা- পরপর অবস্থিত দুটি স্বরধ্বনির মাঝে, একটি স্বরধ্বনি ও তার পরবর্তী ব্যাঞ্জনধ্বনির মাঝে এবং দুটি ব্যাঞ্জনধ্বনি যারা কনসোনেন্ট ক্লাস্টার গঠন করে তাদের মাঝে। অস্ট্রোএশিয়াটক ভাষাগোষ্ঠীর মন-খেমের শাখার মতো মুন্ডারি ভাষায় টোনের অস্তিত্ব নেই। তবে এই ভাষায় ইনটোনেশন প্যাটার্নের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। বিবৃতিমূলক বাক্যের ক্ষেত্রে শব্দের অন্তস্থ সিলেবল এ ফলিং ইনটোনেশন পড়ে। প্রশ্নসূচক বাক্যের ক্ষেত্রে শব্দের অন্তস্থ সিলেবল এ ফলিং-রাইজিং ইনটোনেশন পড়ে। নেতিবাচক বাক্যের ক্ষেত্রে না সূচক হিসেবে ‘কা’ পার্টিকেল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অন্য না-সূচক মার্কারটি হলো ‘চি’। বিবৃতিমূলক এবং না-সূচক উভয়প্রকার বাক্যের ক্ষেত্রে একই পিচ-প্যাটার্ন ব্যবহৃত হয়। মুন্ডারি ভাষায় শব্দের শ্রেণিবিভাগ খুব একটা স্পষ্ট নয়। বিশেষ্যর দুটি শ্রেণি রয়েছে, যথা জীব ও জড়। জীবের মধ্যে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী পড়ে, এছাড়া স্বর্গীয় বস্তু এবং অতিপ্রাকৃত বস্তুকেও জীব হিসেবে গণ্য করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের মধ্যে বিভেদ করার জন্য মুন্ডারি ভাষায় বিশেষ্যর পূর্বে একটি মডিফায়ার ব্যবহার করা হয়। মহিলা বোঝাতে ‘এঙ্গা’ এবং পুরুষ বোঝাতে ‘সাঙ্গদি’ ব্যবহার করা হয়। আত্মীয়তাসূচক শব্দের ক্ষেত্রে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘কোড়া’ এবং মহিলার ক্ষেত্রে ‘কুড়ি’ শব্দ মডিফায়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

গ্রন্থপঞ্জী :