লেপচা ভাষা
লেপচা জনজাতি ভারতের সিকিম রাজ্যে বসবাসকারী তিনটি জনজাতির অন্যতম। অপর দুটি জনজাতি যথাক্রমে নেপালী ও ভুটিয়া। এই জনজাতির ভাষাটিও লেপচা- অর্থাৎ জনজাতি ও ভাষা সমনামে পরিচিত। সিকিম রাজ্য ছাড়াও পশিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায়, পূর্ব নেপালের ইলাম প্রদেশে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ভুটানে লেপচা জনজাতির মানুষের বসবাস।
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে লেপচা ভাষা টিবেটো-বার্মিজ শাখার হিমালয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা (সিং ২০০১, ১০০)। গ্রিয়ারসন (১৯৬৭) এর মতে লেপচা ভাষা ‘নন-প্রোনমিনাল’ এবং এই ভাষার উপর মান্ডারিন এর প্রভাব রয়েছে। ও’ ম্যালি (১৯২৭, ২২২)র মতে লেপচা ভাষা তিব্বত-চীন ভাষা পরিবারের অন্তর্গত টিবেটো-বার্মিজ শাখার তিব্বত-হিমালয় উপশাখার একটি ভাষা। বডম্যান এর মতে লেপচা ভাষার সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশে ব্যবহৃত আদি ভাষার নিকটতম সম্বন্ধ বর্তমান। লেপচা বর্তমানে সিকিম রাজ্যে সরকারি ভাষা হিসেবে পরিচিত ও ব্যবহৃত হয়। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৬৬৫০০ জন মানুষের মাতৃভাষা লেপচা। এই জনজাতির নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে, লেপচা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পুর্ণ স্বাধীন। এই ভাষায় উদ্ভিদ সহ সমস্ত প্রকার জীবের স্বতন্ত্র পরিচিতি বর্তমান (ম্যাকডোনাল্ড ১৯৪৩, ৬-৭)। লেপচা ভাষায় সমস্ত বন্যজীবের নাম ‘s’ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ হয়; যথা- suna- ভাল্লুক, suchyak- চিতাবাঘ, suhu- বানর, suyol- শিয়াল, suthong- বাঘ ইত্যাদি। সমস্ত নদীর নাম ‘r’ অক্ষরে আরম্ভ হয়। যেমন- runyoo- তিস্তা, rungit- রঙ্গিত, runpo- রংপো ইত্যাদি। লেপচা ভাষায় সম্মানার্থক শব্দের অনুপস্থিতি লেপচা সমাজের জাতি-ধর্ম-বর্ণগত সাম্যের পরিচয় বহন করে। তিব্বতি ভাষার অনুপ্রবেশের ফলে বর্তমানে লেপচা ভাষায় বেশ কিছু সম্মানার্থক শব্দের প্রবেশ ঘটেছে। লেপচা জনজাতির অধিকাংশ মানুষ ধর্মান্তর ও রাজ্য সরকারি সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় লেপচার পরিবর্তে তিব্বতি, নেপালী ও ভুটিয়া ভাষার ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় সর্বপ্রথম লেপচা জনজাতির মধ্যে দ্বিভাষিক প্রবণতা ও নেপালী ভাষা ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ লক্ষ্য করা যায়।
সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় বহু উপজাতির মানুষের বসবাস যাদের নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বর্তমান। এই বহুভাষিক চরিত্র লেপচা ভাষার ক্রমহ্রাসমান ব্যবহারিক গুরুত্বের অন্যতম কারণ। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালী ও তিব্বতী- এই সরকারি ভাষাগুলির ব্যবহারিক গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে লেপচা ভাষা ক্রমশ পার্শ্বরেখায়িত হয়ে পড়ছে (তামসাং ১৯৯৮, ২১)। বর্তমানে লেপচা জনজাতির ৮৫ শতাংশ মানুষ দ্বিভাষিক অথবা ত্রিভাষিক (দেবী, ২০১৮)।
লেপচা ভাষার নিজস্ব ও সম্পুর্ণ লিপি বর্তমান, সপ্তদশ শতাব্দীতে থেকং মেনসালং এর দ্বারা এই স্বতন্ত্র লিপির বিকাশ ঘটে। এই ভাষায় সম্পূর্ণ বিকশিত লিপির উপস্থিতির কারণে লেপচা জনজাতির নিজস্ব সাহিত্যকর্মেরও বিকাশ ঘটে। লেপচা ভাষার সাহিত্যকীর্তিগুলি তিব্বতিরা নিজেরদের ভাষায় অনুবাদ করতে সমর্থ হয়েছেন। পদ্মসম্ভব এর জীবনীগ্রন্থ- তাসি নামথার অথবা নামথার সাং-লেপচা লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্বের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়। লেপচাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে খিষ্টান মিশনারীরা ‘জেনেসিস’, ‘এক্সোডাস’, ‘মার্ক ও জনের গসপেল’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি লেপচা ভাষায় অনুবাদ করেন যা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রিত হয়। বেঙ্গল স্টাফ কর্পস এর কর্নেল G.B. Mainwaring ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম লেপচা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন।
প্রাক-স্বাধীনতা কালে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম স্কুলপাঠ্য ভাষা হিসেবে লেপচা ভাষার অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হলেও ব্রিটিশ সরকার তা গ্রহণ করেনি। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লেপচা পরিষদ গঠিত হয় যা বর্তমানে (১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে) অখিল ভারতীয় আদিবাসী পরিষদের আওতাভুক্ত। সংগঠনটি বর্তমানে ‘আদিবাসী লেপচা উপজাতি পরিষদ’ (Indigenous Lepcha Tribal Association) নামে পরিচিত। এই সংগঠনটির আগ্রহ ও উৎসাহে লেপচা জনজাতির মানুষ নিজেদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের সংরক্ষণ ও পুনর্জীবনে অনলস পরিশ্রম করে চলেছেন। স্কুলপাঠ্য ভাষা হিসেবে লেপচা-র অন্তর্ভুক্তি, লেপচাদের উপজাতি শংসাপত্র প্রদান, জনগণনার দ্বারা লেপচা জনজাতির মানুষের সঠিক সংখ্যার প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়ে উক্ত পরিষদ নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হিন্দি তিব্বতি ও নেপালী ভাষায় পাঠক্রম শুরু হলেও, দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি প্রধান ভাষার (নেপালী, তিব্বতি ও লেপচা) একটি হওয়া সত্ত্বেও লেপচা ভাষার উন্নয়নে যথাযথ নজর দেওয়া হয়নি।
গ্রন্থপঞ্জী :
Devy, G. N. & Pandey, Balaram. THE LANGUAGES OF SIKKIM, People’s Linguistic Survey of India. Orient Blackswan, 2017.
Grierson, G.A. Linguistic Survey of India Vol 3, Part 1. Motilal Banarasidas, 1967.
Census of India -1931, 2011
Singh, K.S.et al. People of India, Sikkim, Anthropological Survey of India. Seagull Books, 1993.
Tamsang, K.P. The Unknown and Untold Reality about the Lepchas. Mani Printing Press. 1998.
Ezung, M. 2014. Traditional Religion of the Lotha-Nagas and the Impact of Christianity; PhD Thesis, Nagaland University.
Pradhan, Alina. Language Movement in the Darjeeling Himalayas: Special Reference to the Lepcha Language. LANGUAGE IN INDIA, 2012.
Subba, Tanka.B. The Lepchas: From Legends to the Present Day. RELIGION AND SOCIETY, 1985.