পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা
২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাকে ভেঙে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই জেলার উত্তরে বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা রাজ্য; এবং উত্তর-পূর্বে হুগলি জেলা অবস্থিত। এই জেলার পশ্চিমাংশ ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মোট আয়তন ৬৩০৮ বর্গকিমি এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে মোট জনসংখ্যা ৫৯১৩৪৫৭ জন এবং জনঘনত্ব ৯৪০ জন/বর্গকিমি।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা। মান্য চলিত বাংলা ভাষা পশ্চিম মেদিনীপিরে নিজস্ব রূপ নিয়েছে। বিভাজনের পর পূর্বতন মেদিনীপুর জেলার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলি পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে জঙ্গলমহল নামে পরিচিত অংশগুলি নিয়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে পৃথক ঝাড়গ্রাম জেলার সৃষ্টি হওয়ায় এই জেলার জনজাতি জনসংখ্যারও হ্রাস ঘটেছে। এই জেলার জনজাতিগুলির মধ্যে লোধা ও খাড়িয়া শবর উল্লেখযোগ্য। লোধা জনজাতির ভাষা ‘লোধী’ নামে পরিচিত, যা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত। মুণ্ডা শাখার অপর ভাষা ‘সোরা’ এর সাথে লোধী ভাষার মিল রয়েছে। এই জনজাতির মানুষ বর্তমানে প্রধানত মুসলিম ধর্মাবলম্বী। পশ্চিমবঙ্গের মোট উপজাতি জনসংখ্যার ১.৯ শতাংশ লোধা জনজাতির মানুষ; এদের সার্বিক শিক্ষার হার ৩৪.০৮ শতাংশ। বৃটিশ সরকার লোধা জনজাতিকে অপরাধপ্রবণ জনজাতি হিসেবে চিহ্নিত করলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে এই আইন (ক্রিমিনাল ট্রাইবস এক্ট) তুলে নেওয়া হয়। এই জনজাতি পূর্বে অরণ্যচারী জীবন যাপন করলেও বর্তমানে তারা কৃষিকাজে অভ্যস্ত| দেহগাঠনিক দিক থেকে লোধাদের মুখাবয়ব মাঝারি, চ্যাপ্টা নাক, গায়ের রঙ বাদামী। লোধা জনজাতির গ্রামগুলি জনবসতি থেকে দূরে, জঙ্গলের ভিতর অবস্থিত। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘লোধা ডেভেলপমাণ্ট সেল’ সর্বপ্রথম লোধাদের গৃহনির্মাণের বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে। এদের বাড়ির ছাদ ‘খাপ্পের’ নামক স্থানীয় টালির তৈরি হয়, অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দের কারণে ধাতুনির্মিত বাসনপত্রের পরিবর্তে মাটির বাসনপত্র বেশি ব্যবহৃত হয়। লোধাদের নিজস্ব বিশ্বাস অনু্যায়ী তাদের জীবন এবং কর্ম অতিপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এই অলৌকিক শক্তিগুলি তাদের আশেপাশেই বনের ভিতর ও নদীর ধারে বসবাস করে। লোধারা অপদেবতায় বিশ্বাসী, যার ফলে লোধা সমাজে চিকিৎসক হিসেবে ‘গুণীন’ এর কাছে যাওয়ার চল আছে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তে বনবাসী লোধারা চিকিৎসার জন্য ভেষজ গাছগাছড়ার উপরেই নির্ভর করে।
এছাড়া পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় খাড়িয়া-শবর এবং ভূমিজ জনজাতির বাস। খাড়িয়া-শবর জনজাতি খাড়িয়া ভাষার ব্যবহার করে যা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত। এই ভা্ষার মৌখিক রূপ থাকলেও লেখার কাজে দেবনাগরী এবং ল্যাটিন লিপিও ব্যবহৃত হয়। এই জনজাতিও জঙ্গলে শিকার ও বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধমে জীবিকা নির্বাহ করে। ভূমিজ সম্প্রদায়ের ভাষাও ভূমিজ নামে পরিচিত যাকে মুণ্ডারি ভাষার একটি প্রকার বলে মনে করা হয়। এটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর উত্তর মুণ্ডা শাখার খেরওয়ারী উপশাখার অন্তর্ভুক্ত। এই জনজাতির ভাষাগুলি লেখাপড়ার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে এদের মধ্যে একটি সহজাত দ্বিভাষিক প্রবণতা এবং দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা এবং অপর স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা সাঁওতালির ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছে।
