থাডৌ ভাষা
থাডৌ ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাগোষ্ঠীর কুকিচীন-মিজো শাখার উত্তর উপশাখার একটি ভাষা। এটি মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত মণিপুর ও অসম রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের তরাই-ডুয়ার্স অংশে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী থাডৌ জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। থাডৌ জনজাতি থাডো, থাডো-পাও, থাডো-কুকি ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে থাডৌ ভাষা ২২৯৩৫০ জন মানুষের মাতৃভাষা। এই ভাষার মানুষ মূলত মণিপুর রাজ্যের চান্দেল ও সেনাপতি জেলা এবং অসমের কার্বি-আংলং এবং ডিমা-হাসাও জেলায় বসবাস করেন।
থাডৌ ভাষার বেশ কয়েকটি ভ্যারাইটি অর্থাৎ প্রকারের অস্তিত্বের কথা জানা যায়; যেমন- হাংসিং, খোংসাই, কিপগেন, সামিনার ইত্যাদি। থাডৌ ভাষার প্রকারগুলির নাম মূলত এই জনজাতির গোত্রগুলির নাম অনুসারে হয়। এদের মধ্যে সামিনার প্রকারটি ত্রিপুরা রাজ্যের একটি গ্রামে মাত্র চারজন অধিবাসীর দ্বারা ব্যবহৃত হয় বলে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। মণিপুর রাজ্যে ব্যবহৃত প্রকারটির সঙ্গে পাইতে, হামার, ভাইপেই, সিমতে, কোম ইত্যাদি ভাষার আংশিক পারস্পরিক বোধগম্যতা রয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপি ও লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব নেই। লেখার কাজে মূলত দেবনাগরী, ল্যাটিন ও অসমীয়া লিপি ব্যবহার করা হয়। থাডৌ ভাষায় মোট ২২টি ব্যঞ্জনধ্বনি এবং ৬টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির মধ্যে প্লোসিভ (ভয়েসলেস, অ্যাস্পিরেটেড ও ভয়েসড), অ্যাফ্রিকেট, ন্যাসাল, ফ্রিকেটিভ (ভয়েসলেস, ভয়েসড ও ল্যাটারাল) এবং অ্যাপ্রক্সিমেন্ট ধ্বনির ব্যবহার রয়েছে। শব্দের শেষে /p/, /t/, /k/ আনরিলিজড অবস্থায় বসে। ফ্রন্ট ও সেন্ট্রাল স্বরধ্বনির আগে বসলে /ts/ এপিকালভাবে উচ্চারিত হয়। স্বরধ্বনিগুলি মূলত উচ্চারণের স্থান অনুসারে ফ্রন্ট, সেন্ট্রাল ও ব্যাক এবং উচ্চারণের পদ্ধতি অনুসারে ক্লোজ, মিড ওপেন- এই তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। থিরুমালাই (১৯৭২), হাইম্যান (২০০৪) এবং হাওকিপ (২০০৮) থাডৌ ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেও এই ভাষার মরফোলজি অর্থাৎ শব্দতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব অর্থাৎ সিনট্যাক্স এবং সোশিওলিঙ্গুইস্টিক্স সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব রয়েছে। শ্রী কৃষ্ণ (১৯৮০) থাডৌ ভাষার একটি ব্যাকরণ রচনা করেছেন, যেখানে ভাষাটির ইনফ্লেক্সনাল মরফোলজি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে; কিন্তু এই ভাষার ডেরিভেশনাল মরফোলজি সম্পর্কে কোনো তথ্য সেখান থেকে পাওয়া যায় না। থাডৌ ভাষার বহুল ব্যবহৃত ডেরিভেশনাল প্রিফিক্সটি হলো /â/, যেটি প্রধানত রিলেটিভ মার্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিব্বত-বর্মীয় শাখার ভাষাগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিলেটিভ মার্কারকে নমিনালাইজ করে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যা থাডৌ ভাষার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এছাড়া থাডৌ ভাষায় ব্যবহৃত অপর দুটি ডেরিভেশনাল সাফিক্স হলো /-nda/ ও /-ta?/, যেগুলি মূলত গ্রামাটিকাল ক্লাস-চেঞ্জিং সাফিক্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কুকিচীন শাখার অন্যান্য ভাষার মতোই থাডৌ ভাষাও একটি অ্যাগ্লুটিনেটিভ ভাষা। এই ভাষার সর্বনামের ক্ষেত্রে তিনটি বচন ( একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন) এবং ৪টি পুরুষ- উত্তম (ইনক্লুসিভ ও এক্সক্লুসিভ), মধ্যম ও প্রথম এর অস্তিত্ব রয়েছে। থাডৌ ভাষার ক্রিয়াপদ ও তার আর্গুমেন্টগুলির মধ্যে এগ্রিমেন্ট মার্কিং এর অস্তিত্ব রয়েছে। ক্রিয়াপদ এবং বাক্যের কর্তার মধ্যে পুরুষের ভিত্তিতে যে এগ্রিমেন্ট ঘটে, তা মূলত ক্রিয়াপদের পূর্বে একটি নির্দিষ্ট প্রেফিক্সের ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝানো হয়ে থাকে। /-nda/ সাফিক্সটির মূল কাজ হলো ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়াপদকে নমিনালাইজ করা। এছাড়া এই সাফিক্সটি পারফেক্টিভ মার্কার হিসেবেও কাজ করে। কম্পাউন্ড ওয়ার্ড অর্থাৎ যৌগিক শব্দের গঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যৌগিক শব্দের উপাদান হিসেবে যে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় তাদের পৃথক ও নিজস্ব আভিধানিক অর্থ থাকলেও যৌগিক শব্দটিও পৃথকভাবে অভিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। থাডৌ ভাষার বিশেষ্য, ক্রিয়া এবং ক্রিয়াবিশেষণের রিডুপ্লিকেশন দেখা যায়, যেটি এই ভাষার একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশেষ্যের ও সর্বনামের রিডুপ্লিকেশনের নিদর্শন থাডৌ ভাষায় খুব বেশি দেখা না গেলেও এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে-নাউন অর্থাৎ বিশেষ্যের রুট অর্থাৎ মূলটির পরিবর্তে সমগ্র বিশেষ্যখণ্ড অর্থাৎ নাউন-ফ্রেজটিরই রিডুপ্লিকেশন ঘটে। রিডুপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে ভার্বাল রিফ্লেক্সিভ /-ki/ এবং রিডুপ্লিকেটেড বাউন্ড প্রোনাউন- এই দুটি অংশ থাকে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India- 2011
Dattamajumdar, S. The Socio-Economics of Linguistic Identity: A Case Study in the Lushai Hills; Ph.D. dissertation
Pauthang, H. 2014. Word formation in Thadou; Himalayan Linguistics