ধীমাল শব্দটির কোন স্বতন্ত্র অর্থ নেই, পার্শ্ববর্তী থারু ও রাজবংশী জনজাতির মানুষ এদের ধীমাল নামে অভিহিত করে। মেচ জনজাতি এদের ‘মাইকো’ নামে অভিহিত করে। এই জনজাতি কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, যথা ডোঙ্গে, ডিং, তালিপা, হার্দিয়া, নুনিয়া, লেংবাং, থারু, লাতের, যোগী ইত্যাদি। ধীমাল জনজাতির মানুষ তাদের বসবাসের গ্রামগুলিকে নতুন ও পুরোনো এই দুটি ভাগে ভাগ করে- প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী বসবাসের স্থানগুলি পুরোনো এবং নতুন গড়ে তোলা বসতি এলাকাগুলিকে এরা পৃথকভাবে চিহ্নিত করে। গ্রামগুলি আয়তনে বেশ ছোট হয়, একএকটি গ্রামে সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০টি বাড়ি থাকে। বাড়িগুলি মূলত একতলা হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং দরজা ও দেওয়ালগুলি সূর্য, পাখি, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো থাকে। গৃহদেবতা ‘সাকোদির’কে বাড়ির পূর্বদিকে স্থান দেওয়া হয়। রান্নাঘর মূল বাড়ি থেকে পৃথক থাকে অথবা মূল বাড়ির এককোণে অবস্থিত হয়। গবাদি পশুর বাসস্থান মূল বাড়ি থেকে বেশ দূরে থাকে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত ধীমালরা সেমি-নর্মাডিক যাযাবর জীবন যাপন করতো; কোনো একটি জায়গায় চার পাঁচ বছরের বেশি তারা এক নাগাড়ে বাস করতো না। ভূমির অনুর্বরতা, যাযাবর জীবনের প্রতি আসক্তি ইত্যাদি ছিল মূল কারণ। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে তরাই অংশে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ বসতি গড়ে তোলে, তখন ধীমাল জনজাতিও যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে এলটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়।
দৈহিক গঠনের দিক থেকে ধীমালরা মোঙ্গলয়েড আকৃতির। দেহবর্ণ গাঢ় বাদামি, চুল ঘন কালো, চোখ ছোট, ভ্রু পাতলা, চোখের উপরের পাতা উল্টোনো। নাক চ্যাপ্টা ও শক্তপোক্ত দেহাকৃতি। রাই এবং লিম্বু জনজাতির তুলনায় উচ্চতা বেশি। এদের পোশাক এদের দৈহিক গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পুরুষদের পোশাকের মধ্যে ধুতি, ভোটো, টুপরি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত পোশাকটি হলো দাউরা সুরুয়াল। ধীমাল মহিলারা এখনো ‘বোনা’ নামে একটি বিশেষ পোশাক ব্যবহার করে যা হলো ৫-৬ ফুট লম্বা একপ্রকার হাতে বোনা কাপড় যা বুক থেকে হাঁটু অবধি আবৃত রাখে। ব্লাউজ ‘চোলা’ নামে পরিচিত, যা খুব বেশি ব্যবহার করা হয় না। ‘বোনা’ পোশাকটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যথা ইতাঙ্গি, পাতালোই, সামুথি, দাবোনা ইত্যাদি- এই নামগুলি নকশার বিভিন্নতা অনুসারে দেওয়া হয়। এই পোশাকটিতে কালো রঙ সাধারণভাবে থাকে। পুরুষদের মধ্যে আঙ্ঘুটি অর্থাৎ আংটি ছাড়া তেমন কোন গয়নার প্রচলন নেই। ধীমাল জনজাতির মহিলারা ‘পুয়ালো’, ‘নাদোই’, ‘খুন্তিলা’, ‘সাংখাই’, ‘থোকা’ ইত্যাদি গয়না ব্যবহা করে। কপালে টিকা বা সিঁদুরের কোনো ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।
এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল হলো ধান। এরা গোহোরো নামে এক বিশেষ প্রকার কুমিরের মাংস ধীমালজনজাতির মানুষ আহার করে। মাছ ধরা ও শিকারের উদ্দেশ্যে এরা ‘গুলথাই’ (গুলতি), ‘ধানুখের’ অর্থাৎ ধনুক, ‘খাপার’ ইত্যাদি ব্যবহার করে। মাছ ধরার জন্য জালের পরিবর্তে বড়শি ও ছিপ ব্যবহার করে।
শিশুর জন্মের সময় কোনো অনুষ্ঠান পালিত হয় না। জন্মের পরদিন শিশুর নামকরণ করা হয়। যে বারে শিশুর জন্ম সেই বারের নাম অনুসারে এই নামকরণ করা হয়। বিয়ের সময় ছেলেকে নিজেই তার পাত্রী খুঁজে নিতে উৎসাহিত করা হয়। প্রেমবিবাহ ও সম্বন্ধবিবাহ ছাড়া বলপূর্বক বিবাহও ধীমাল সমাজে প্রচলিত। মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সমাহিত করা হয়। বিবাহিত ও অবিবাহিতদের সমাধি দেওয়ার প্রথা প্রায় একই রকম। সমাধি দেওয়ার সময় মুরগি উৎসর্গ করা হয়। ব্যাক্তির মৃত্যুর পর চতুর্থ দিনে ‘কামপাপি’ অর্থাৎ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পালন করা হয়।
ধীমাল জনজাতির উন্নত লোকসাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এদের লোককথা মূলত মৌখিক, লিপির অভাবে তা লেখ্য ভাষায় সংকলিত হয়নি। লোকগানের মধ্যে ‘তুরি’ ও ‘পোটো’ নামক লোকগান বিশেষ প্রচলিত। পরব বা ‘তিহার’ উৎসবের সময় এরা নৃত্যও প্রদর্শন করে। অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫দিন ধরে পূর্বে এই নাচ অনুষ্ঠিত হতো। এই নৃত্যগুলি বিভিন্ন প্রকারের হতো। ‘পোয়োপকা’, ‘উতাঙ্গা’, ‘বিন্দাহেরকা’ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন নাচ তারা প্রদর্শন করে। এই নাচগুলির সময় পুরুষ-নারী নির্বিশেষে মাথা ঢেকে রাখে অলগি নামে এক বিশেষ হাতে বোনা শালের মাধ্যমে। এই নাচগুলির সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রও বাজানো হয়। ‘ভালে’, ‘বোমানা’, ‘মুচুঙ্গা’, ‘উর্নি’ ইত্যাদি তারের বাদ্যযন্ত্র এরা ব্যবহার করে। এছাড়াও ‘তুমজাল’, ‘দাউদারা’, ‘সারেঙ্গা’ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রগুলি তৈরি করার দক্ষ কারিগরের অভাবে ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই প্রাচীন ধীমাল রীতিগুলি পরিবর্তিত হয়েছে। আগে এরা প্রকৃতি উপাসনা করলেও বর্তমানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান- এই তিন ধর্মের প্রতিই আসক্তি দেখা যায়। ফলে ধীমাল ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবর্তনের ফলে তাদের নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবনমন ঘটছে।
Census of India, 2011
Dhimal, S.B. 1973 Brief Introduction of the Dhimal
King, John.T 2008 A Grammar of Dhimal.