পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

মুন্ডারি সংস্কৃতি

অন্যান্য জনজাতির মতোই মুন্ডারা পূর্বে নোমাডিক শিকারি হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এরা মূলত কৃষিকাজ, ঝুড়ি তৈরি, কাপড় বোনা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। মুন্ডা সমাজের গোত্রগুলি ‘কিল্লি’ নামে পরিচিত, সংস্কৃত ‘কুল’ শব্দের সঙ্গে যার মিল রয়েছে। এই গোত্রগুলি উপাস্য টোটেম এর নাম থেকে উদ্ভুত হয়েছে; এরকম কয়েকটি গোত্র হলো ‘বা’ (মাছ), ‘বাবা’ (ভাত), ‘বোদরা’, ‘বালমুচু’ (মাছ ধরার জাল), ‘বারলা’, ‘হেমব্রম’ (গাছ), ‘হোরা’ (কচ্ছপ) ইত্যাদি। এদের প্রধান পালিত উৎসবগুলি হলো মাঘ পরব, ফাগু, করম পরব, সারহুল, সোহরাই ইত্যাদি। মাঘ পরবটি হো জনজাতির মধ্যে বহুল প্রচলিত হলেও মুন্ডা তথা সাধারণ অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোষ্ঠীর মানুষ এটি অল্পবিস্তর পালন করেন। মুন্ডা ক্যালেণ্ডার অনুসারে ‘মাগে পোনাই’ মাসে প্রধান দেবতা সিংবোঙ্গার সম্মানে এই উৎসব পালিত হয়। বাহা পরব অর্থাৎ বা পরবটিও, হো, সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি জনজাতি নির্বিশেষে পালিত হয়। অস্ট্রো-এশিয়াটিক অভিধান অনুসারে ‘বা’ অথবা ‘বাহা’ শব্দের অর্থ হলো ফুল। এই উৎসবে ‘নাইক’ অথবা ‘দেউড়ে’ অর্থাৎ পুরোহিত একটি বিশেষ আচার পালন করেন। একটি কুলো বা ধামাতে শাল গাছের ফুল ও পাতা সংগ্রহ করে ‘জহর থান’ অর্থাৎ দেবস্থানে ‘জহর আরা’ অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এই আচারটি পালনের পর নাইক অর্থাৎ পুরোহিত ঐ কুলো হাতে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে প্রত্যেককে আশির্বাদ করেন। বাড়ির মেয়েরা পুরোহিতের হাতে খাবার তুলে দেন ও তার পা ধুইয়ে দেন। এরপর নাচ, গান ও তীর ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা হয়। কুর্মি, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি জনজাতি দীপাবলির সময় সোহরাই উৎসব পালন করেন। এই উৎসবকে ‘বাঁদনা পরব’ও বলা হয় যেটি কার্তিক মাসের অমাবস্যায় পালন করা হয়। বাড়ির মাটির দেওয়াল পরিষ্কার করে সেখানে বাড়ির মহিলারা আলপনা দেন এবং সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হয়। মুন্ডা জনজাতির নিজস্ব নাচ-গান ও লোককথার ঐতিহ্য রয়েছে। মুন্ডাদের নিজস্ব নাচ ও গান তাদের ভাষায় যথাক্রমে ‘দুরাং’ ও ‘সুসান’ নামে পরিচিত। এদের গানের প্রধান যন্ত্র ‘নকরেহ’ নামে পরিচিত। এদের প্রচলিত ধর্ম হলো সারনা ধর্ম; যে ধর্মে অনুসারে এরা প্রকৃতি ও টোটেম উপাসনায় বিশ্বাসী। এদের প্রধান দেবতা হলেন সিংবোঙ্গা অর্থাৎ সূর্যদেবতা।

মুন্ডা সমাজে শিশুর জন্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরিবারে ছেলের জন্ম হলে পরিবারের রোজগার বাড়বে এই ভেবে উৎসব পালন করা হয়; আবার কন্যাসন্তানের জন্ম হলে পরিবারের সকলের যত্ন নেবে এই আশায় উৎসব পালন করা হয়। এই সমাজের বিবাহের পূর্বে এনগেজমেণ্ট পর্বটি ‘লোটা-পানি’ নামে পরিচিত। বিবাহের পূর্বে বর অর্থাৎ ছেলের বাবা মায়ের হাতে ‘ডালি-টাক্কা’ অর্থাৎ আর্থিক পণ তুলে দিতে হয়। সাধারণত মুন্ডা সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন নেই। বিবাহ উৎসব এক সপ্তাহ ধরে অনুষ্ঠিত হয়। মুন্ডা সমাজে মানুষের মৃত্যু হলে মৃতদেহ দাহ করার পরিবর্তে সমাধি দেওয়া হয়। সমাধির পূর্বে মৃতদেহকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। সাধারণত মানুষের মৃত্যুর ছয়দিন পর তার পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করা হয়।

তবে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই মুন্ডাদের মধ্যে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব বাড়তে থাকে এবং এদের একটি বিরাট অংশ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হয়ে পড়ে। মুন্ডারি ভাষায় বাইবেলের ‘নিউ ট্রেস্টামেন্ট’ অংশের অনুবাদও হয়েছে। পশ্চিমী শিক্ষারীতি ও ইংরেজি শিক্ষার বিকাশের ফলে মুন্ডা সমাজের প্রাচীন রীতিনীতি ও ভাষিক বৈশিষ্ট্যগুলির অবনমন ঘটতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর জনাধিক্যের অভাবে ভাষাটিকে স্কুল পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং এটি সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেনি।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India-2011

MUNDARI LANGUAGE; Ethnologue, SIL International

Osada, Toshiki. 2008. Mundari. In Anderson Gregory (ed.) The Munda languages. New York: Routledge.

Srivastava, M. 2007. The Sacred Complex of Munda Tribe; Anthropologist.

Sidwell, Paul. 2018 Austroasiatic Studies: State of the art in 2018