আঙ্গামী-নাগাদের প্রকৃত নাম ছিল ‘তেনিমিয়া’, যদিও আঙ্গামী নামটি পার্শ্ববর্তী জনজাতিগুলির থেকে পাওয়া। হাটন (১৯২১) এর মতে, ‘আঙ্গামী’ শব্দটি মণিপুরি শব্দ ‘Gnamei’ এর রূপভেদ। সানইয়ু (১৯৯৬) এর মতে ‘গামী’ শব্দ থেকে আঙ্গামী শব্দের সৃষ্টি যার অর্থ আক্রমণকারী। এই জনজাতি এবং তাদের ভাষা সমনামে পরিচিত। এদের পূর্বতন নাম ‘তেনিমিয়া’ বলতে বর্তমানে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যার মধ্যে আঙ্গামী, রেংমা, জেলিং, পচুরি, চাখেসাং, মাও ইত্যাদি জনজাতিগুলি আসে।
এই জনজাতি প্রধানত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল এবং ধান এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল। অন্যান্য নাগা জনজাতির সঙ্গে আঙ্গামী নাগাদের প্রধান পার্থক্য হলো এরা ঝুমচাষের পরিবর্তে জমিতে প্রচলিত প্রথায় কৃষিকাজে অভ্যস্ত। এই কৃষিপদ্ধতি পরিবেশবান্ধব এবং বেশি ফসল উৎপাদনে সহায়ক। বর্তমানে কৃষির পাশাপাশি সরকারি চাকরি এবং অন্যান্য পেশাতেও আঙ্গামী নাগাদের দেখা যায়।
ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে এই জনজাতি আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী; এরা মনে করে যে প্রকৃতি আত্মায় পূর্ণ। এই আত্মাসমূহ উদার অথবা ক্ষতিকর হতে পারে। এই আত্মাসমূহ বিভিন্ন নামে পরিচিত যথা- চুখিয়েও, রুতসে, কেশুদি, তেমি, তেলেফু, রাপুও ইত্যাদি। চুখিয়েও হলেন বন্যজন্তুদের দেবতা, শিকারের সময় পুরুষরা এর উপাসনা করেন। রুতসে ও কেশিদি হলেন মৃত্যুর দেবতা, এই দুই আত্মার সংস্পর্শে এলে মানুষ বাঁচে না। তেমি হলো একপ্রকার অপদেবতা বা ভূত যা মানুষকে ভয় দেখায়। এছারা রাপফে নামে একপ্রকার উপকারী আত্মার উল্লেখ আছে যারা ক্ষতিকারক আত্মার হাত থেকে আঙ্গামী গ্রামগুলিকে রক্ষা করে। আঙ্গামী-নাগা বিশ্বাস অনুযায়ী উদার আত্মাগুলির অধিকাংশই মহিলা এবং দুষ্ট আত্মাগুলির বেশিরভাগই পুরুষ। এই জনজাতির একজন প্রধান দেবতা রয়েছেন যিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র উপস্থিত বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দেবতার নাম ‘উকেপেনুওফফু’ যিনি মহিলা এবং সৃষ্টি ও জন্মের দেবী। আঙ্গামী-নাগাদের প্রাচীন ধর্ম এনিমিস্টক অর্থাৎ প্রকৃতি ও জীবজন্তুর উপাসনার প্রচলন ছিল। বর্তমানে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক নীতির ফলে এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে এই জনজাতির অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
আঙ্গামীদের নিজস্ব গ্রামগুলি ‘রুনা’ নামে পরিচিত যেগুলি একে অপরের থেকে সুস্পষ্ট সীমারেখার দ্বারা পৃথক। গ্রামগুলি মূলত পাহাড়ের উপর অবস্থিত এবং গ্রামের প্রবেশপথ ‘খারু’ নামে পরিচিত। এই সমাজে ‘খারু’ বন্ধুত্ব, শান্তি ও একতার প্রতীক। এই প্রবেশপথটি যুদ্ধের সময় গ্রামকে রক্ষা করতেও ব্যবহৃত হয়। আঙ্গামী গ্রামগুলিতে কোন প্রশাসনিক প্রধান না থাকলেও বৃদ্ধ মানুষরা সমাজ পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এরা উত্তরাধিকার সূত্রে নির্বাচিত হন না, বরং বুদ্ধিমত্তা ও কর্মকুশলতার ভিত্তিতে এদের নির্বাচন করা হয়।
প্রত্যেকটি গ্রাম কয়েকটি ‘খেল’ এ বিভক্ত, ‘খেল’ গোত্র বা ক্ল্যানকে সূচিত করে। প্রত্যেকটি ‘খেল’ এ একটি করে প্রবেশপথ অর্থাৎ ‘খারু’, ‘কিচুকি’ অর্থাৎ অবিবাহিত পুরুষদের একসাথে বসবাসের জায়গা এবং একটি ‘থেহৌবা’ অর্থাৎ উঁচু একটি বসার জায়গা থাকে। কিচুকি তে অবিবাহিত পুরুষরা, সমাজবদ্ধ জীবন এবং যুদ্ধের কৌশল শেখে। ‘থেহৌবা’ মিটিং এর কাজে ব্যবহৃত হয়য়। ‘খেল’ কে আঙ্গামী সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক একক হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি একটি স্বায়াত্তশাসিত একক যার নিজস্ব এলাকা বর্তমান।
আঙ্গামী সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হলেও নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমান মর্যাদা লাভ করেন। লিঙ্গের ভিত্তিতে কাজের বিভাগ এই সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। নারীরা মূলত গৃহ পরিচালনা, সন্তানপালন এবং কৃষিকাজে পুরুষদের সহায়তা করেন। পুরুষরা শিকার, বাণিজ্য, জঙ্গলে কাঠ ও জ্বালানি সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকেন। প্রত্যেকটি গোত্রের নিজস্ব কিছু জমি বর্তমান, জমির উপর উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের অধিকার অর্পিত হয়, নারীরা চাষের কাজে জমি ব্যবহার করলেও উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিকানার অধিকারী নন। যদিও বিধবা এবং বিবাহবিচ্ছিন্ন মহিলারা নিজের জমি কিনতে পারেন। মহিলারা নিজেদের জীবনসঙ্গী নিজেরা বেছে নেওয়ার অধিকারী হলেও গ্রামের প্রধানই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। আঙ্গামী সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন নেই। বিবাহ দুই প্রকার হয়- সামাজিক অনুষ্ঠান ও রীতি মেনে এবং এগুলির অনুষ্ঠান ছাড়া। আঙ্গামী সমাজে বিধবা বিবাহ স্বীকৃত হলেও তা বহুল প্রচলিত নয়। এই সমাজে স্বয়ম্বর প্রথা ও তুতো ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহের রীতিও প্রচলিত। ‘কোখাটা’ অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদের প্রচলন আঙ্গামী সমাজে খুব একটা না থাকলেও বিবাহবিচ্ছিন্নদের পুণর্বিবাহ স্বীকৃত।
শিশুর জন্ম আঙ্গামী সমাজে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সাধারণত একটি মোরগ বলি দিয়ে এটি উদযাপন করা হয়। কন্যাসন্তানের জন্ম হলে মুরগি বলি দেওয়া হয়। আঙ্গামী সমাজে শিশুর জন্মের পর নয়দিন মাকে ঘরে থাকতে ও বিশ্রাম নিতে হয়। মৃত্যুর পর মৃতদেহকে জমিতে সমাধিস্থ করা হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহ গ্রামের বাইরে সমাধিস্থ করা হয়, এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহকে স্নান করিয়ে, তার নিজের জামাকাপড় পরিয়ে গ্রামের ভিতর গোত্রের নিজস্ব জমিতে সমাধি দেওয়া হয়। মৃত্যুর দশদিন পর অন্তিম সৎকার করা হয়। শেষদিন মৃতের আত্মীয়রা একত্রিত হয়ে রান্না করা মাছ ও মাংস আহারের মাধ্যমে অশৌচ শেষ হয়। আঙ্গামী সমাজ মৃত্যুর পর পুণর্জন্মে বিশ্বাস করে না।
আকৃষ্ট হওয়ার ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলির সংরক্ষণে আগ্রহ লক্ষ্যণীয় মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে আঙ্গামী ভাষায় স্কুল কলেজে পাঠ শুরু হলেও এই জনজাতির ৯৮ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে পড়ার ফলে এদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতিগুলি ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে। নিজস্ব উৎসবের পরিবর্তে খ্রিস্টান ধর্মের উৎসব, পোষাক ইত্যাদিতে নতুন প্রজন্ম
Blankenship, Barbara; Peter Ladefoged; Peri Bhaskarrao; Nichumeno Chase (June 1993). Phonetic Structures of Khonama Angami. Fieldwork Studies of Targeted Languages. UCLA Working Papers in Phonetics.
Census of India- 2011