পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

নকটে সংস্কৃতি

এরা প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। গ্রামের প্রধান ‘আং’ অর্থাৎ রাজা নামে পরিচিত। শাসন পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সংসদটি ‘গোয়াং রাং’ নামে পরিচিত। এছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সংগঠন ‘নুথান’ও প্রধানকে সাহায্য করে। প্রত্যেক গ্রামে অবিবাহিত পুরুষদের বাসের জন্য ‘মোরাং’ নামে ডর্মিটরির অস্তিত্ব রয়েছে যেখানে মূলত গ্রামের পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত পুরুষরা একত্রে রাত্রিযাপন করে। অবিবাহিত মহিলাদের জন্য এরকম কোনো একত্রে বসবাসের স্থান নকটে সমাজে প্রচলিত নয়। ধর্মবিশ্বাস অনুসারে এই জনজাতি ‘থেরোবাদী বৌদ্ধধর্ম’ এবং হিন্দুধর্মের অনুগামী। আমেরিকার ব্যাপটিস্ট মিশনারি মাইলস ব্রনসনের মাধ্যমে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে নকটে জনজাতি সর্বপ্রথম খ্রিস্টান ধর্মের সংস্পর্শে আসে। রোমান লিপিতে নকটে ভাষার অনেক বই তিনি লিখেছিলেন। এই ভাষায় উৎসব ‘লোকু’ নামে পরিচিত। নকটে জনজাতির মধ্যে এরকম ১৪টি ‘লোকু’ প্রচলিত, যার মধ্যে প্রধান হলো ‘চালো লোকু’ অর্থাৎ ফসল তোলার উৎসব। অন্যান্য উৎসব ১ অথবা ২ দিন ধরে চললেও ‘চালো লোকু’ অন্তত ৩ দিন ধরে পালিত হয়। গবাদি পশু উৎসর্গ করা, নাচ, গান ইত্যাদির মাধ্যমে পালিত হয়। উৎসবের দ্বিতীয় দিন ‘চামকাটযা’ নামে পরিচিত; যেদিন দেবতার উপাসনা এবং গ্রামপ্রধানের আশির্বাদ নিতে হয়। তৃতীয় অর্থাৎ শেষদিন গ্রামের প্রধান ও প্রবীণ ব্যাক্তিরা গ্রাম থেকে সংগৃহীত ডিম ভেঙে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গের মাধ্যমে গ্রামের সকলের সৌভাগ্য কামনা করেন। সাংস্কৃতিক দিক থেকে নকটে জনজাতির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী নাগাল্যান্ডের ‘কোনইয়াক’ জনজাতির সাদৃশ্য রয়েছে। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী এরা অ্যানিমিস্ট অর্থাৎ জীবজন্তুর উপাসনায় বিশ্বাসী। এদের প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন ‘জাউবান’-সমস্ত উৎসবেই যার উপাসনা করা হয়। বর্তমানে অসমে বসবাসকারী হিন্দু ধর্মের মানুষজনের সংস্পর্শে এসে এদের ধর্মেও লৌকিক হিন্দুধর্মের প্রভাব বেড়ে যায়।

নকটে জনজাতিতে ৪টি প্রধান গোত্র বর্তমান- ‘লোকটাং-সোম চাম’, ‘মাতেয়-সোম চাম’, ‘খাতেয়-সোম চাম’ এবং ‘নুক-পাং-মি চাম’। এরা কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পার্বত্য এলাকায় বসবাসের কারণে প্রচলিত কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তে ঝুমচাষ ও পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ নকটে জনজাতির মধ্যে প্রচলিত। সাধারণত ঝুম চাষের ক্ষেত্রে পরপর দুবছর চাষ করার পর জমিকে দশ থেকে বারো বছর অনাবাদী রেখে পূর্বের উর্বরতা ফিরিয়ে আনা হয়। সেচব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়, বৃষ্টির জলই চাষের প্রধান সহায়ক। প্রধান উৎপাদিত ফসল হলো ধান ও ভুট্টা। প্রধান খাদ্য ভাত হলেও মাছ-মাংস ও শাকসবজি এদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার অন্তর্গত। ভাত ও বাজরার তৈরি একপ্রকার দেশি মদ এবং চা এরা পানীয় হিসেবে গ্রহণ করে।

নকটে সমাজে সম্পত্তির উপর পুরুষদেরই উত্তরাধিকার স্বীকৃত হয়। এমনকি উপহার হিসেবেও বাবা মেয়েকে জমি দিতে পারেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি সর্বদা পরিবারের বড় ছেলে ভোগ করে থাকে। পরিবারের বড় ছেলের অনুপস্থিতিতে নিকট সম্পর্কের কোনো পুরুষের হাতেই সম্পত্তির অধিকার অর্পিত হয়।

বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মের মিশনারিদের প্রভাবে ও ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের ফলে নকটে সমাজের নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য, পোষাক, ধর্মবিশ্বাস ও সমাজব্যবস্থা সবক্ষেত্রেই আধুনিকতার প্রসারের ফলে নকটে জনজাতির মধ্যে সরকারি ভাষার প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে সরকারি সুযোগসুবিধাগুলি গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। লিপির অনস্তিত্ব এবং নকটে ভাষার সরকারি স্বীকৃতির অভাবে নতুন প্রজন্ম এই ভাষা শিখতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তবে সর্বশেষ জনগণনায় ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা এই ভাষার পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত বহন করে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Census of India-2001

Chutia, Kakali. 2019 Study on Nokte Language: An Endangered Language of North-East India; International Journal of Humanities and Social Science Invention. Vol. 8, Issue 09

Das, J.N. The Noctes; 2015

Dutta, Parul Chandra. 1978 The Noctes. Directorate of Research, Govt. of Arunachal Pradesh; Pp. 12-13