মালতো ভাষা
মালতো জনজাতির ভাষা হলো মালতো বা মাল-পাহাড়িয়া, যা পাহাড়িয়া বা রাজমহলী নামেও পরিচিত। প্রধানত পূর্ব ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের উত্তর-পূর্বাংশে ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ জেলার কিছু অংশ এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় এই জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ২৩৪১৯৪, যার মধ্যে ১৫৯২১৫ জন মানুষের মাতৃভাষা হলো মালতো। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম মানুষের মাতৃভাষা হলো মালতো ভাষা।
এই ভাষাটি দ্রাবিড় ভাষাবংশের উত্তর-দ্রাবিড় শাখার কুরুখ-মালতো উপশাখার একটি ভাষা; ফলে কুরুখ ভাষার সঙ্গে এই ভাষার যথেষ্ট ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক সাদৃশ্য রয়েছে। ঝাড়খণ্ড, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয়-আর্য, তিব্বত-বর্মীয় এবং অস্ট্রো-এশিয়টিক ভাষার আধিক্যের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নভাবে কুরুখ ও মালতো এই দুটি দ্রাবিড় ভাষার উপস্থিতি অঞ্চলটির ভাষাগত বৈচিত্র্যের পরিচয় বহন করে। তবে মালতো ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, লেখার কাজে দেবনাগরী ও বাংলা লিপিই ব্যবহৃত হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাংলা, হিন্দি, কুর্মালি প্রভৃতি ভাষার আধিক্য থাকার ফলে ভাষাটিকে অনেকসময় দ্রাবিড় ও ভারতীয় আর্য ভাষার মিশ্রিত রূপ হিসেবেও গণ্য করা হয়। মালতো ভাষায় মূলত দুটি প্রকারের অর্থাৎ ভ্যারাইটির অস্তিত্বের কথা ভাষাতাত্ত্বিকরা স্বীকার করেন- কুমারভাগ পাহাড়িয়া ও সৌরিয়া পাহাড়িয়া। এই দুটিকে অনেকসময় পৃথক দুটি ভাষা হিসেবেও গণ্য করা হয়। প্রথম প্রকার অর্থাৎ কুমারভাগ পাহাড়িয়া মূলত পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশার বিচ্ছিন্ন অংশে প্রচলিত। অন্যদিকে মূলত বিহার ও বিহার সীমান্তবর্তী মালদহ জেলার গ্রামীণ এলাকায় সৌরিয়া পাহাড়িয়া প্রকারটির প্রচলন রয়েছে। এই দুটি প্রকারের মধ্যে তুলনামূলক বিচারে প্রায় ৮০ শতাংশ শাব্দিক সাদৃশ্য রয়েছে। মালতো ভাষায় অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষার মতোই ৫টি প্রধান স্বরধ্বনি ও ৫টি উক্ত স্বরধ্বনির দীর্ঘরূপ প্রচলিত। এই ৫টি স্বরধ্বনি হলো, ‘অ’, ‘এ’, ‘ই’, ‘ও’ এবং ‘উ’। এই ভাষায় কোনো ভাওয়েল ক্লাস্টার বা ডিপথং-এর অস্তিত্ব নেই। এছাড়া মালতো ভাষায় ২৩টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব আঁচে, যাদের মধ্যে স্টপ, ফ্রিকেটিভ, ন্যাসাল, এপ্রক্সিমেণ্ট ও ট্রিল- এই পাঁচ প্রকারের অস্তিত্ব রয়েছে, ট্যাপ ও ফ্ল্যাপ এর কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। মালতো ভাষায় ব্যাকরণগত লিঙ্গ অর্থাৎ গ্রামাটিকাল জেন্ডার বর্তমান। লিঙ্গ এই ভাষাতে তিন প্রকার- পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ। পুরুষ অথবা প্রধান দেবতাদের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলোক এবং অপ্রধান দেবতাদের ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়। তবে পবিত্রতা এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বোঝাতে মালতো ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়, যা এই জনজাতির মধ্যে স্ত্রীলোকের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি সূচিত করে। ‘বাবা’ শব্দের প্রচলিত রূপ ‘আব্বা’ এই ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিশেষ্য পদের ক্ষেত্রে ক্লীবলিঙ্গসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়। এই জনজাতির মানুষের সার্বিক শিক্ষার হার খুব কম; মূলত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের প্রান্তিক জীবনযাত্রায় লেখাপড়ার সুযোগসুবিধা কম থাকাই এর প্রধান কারণ। এই জনজাতির মানুষ প্রধানত ত্রিভাষিক- এরা মালতোর পাশাপাশি সাঁওতালি এবং হিন্দি ও বাংলার যেকোনো একটিতে পারদর্শী। গ্রামীন পারিবারিক জীবনে এরা মালতো ভাষা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ও অন্যান্য জনজাতির সাথে বাক্যালাপের সময় সরকারি ভাষা হিন্দি, বাংলা অথবা সাঁওতালি ব্যবহার করে। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর মূল ধারার ভাষাগুলি থেকে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিচ্ছিন্ন ভাষা হওয়াতে মালতো ভাষায় কিছু প্রোটো-দ্রাবিড়িয় অর্থাৎ আদি দ্রাবিড়িয় বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছে। মালতো ভাষায় বাক্যের ক্রিয়া প্রধানত একটি মূলরূপ অর্থাৎ স্টেমের সাথে এক বা একাধিক সাফিক্স যোগে গঠিত হয়। ক্রিয়ার অতীত কালের রূপটি মূলরূপের পরিবর্তন অর্থাৎ স্টেম অল্টারেশন এবং সাফিক্স যোগ এই দুইভাবে পাওয়া যেতে পারে। একটি স্বাধীন বাক্যাংশ অর্থাৎ ইন্ডিপেণ্ডেন্ট ক্লজের হেড হিসেবে বিবাচিত হওয়ার জন্য মালতো ভাষায় ক্রিয়ার মূলরূপকে একটি ইনফ্লেক্সনাল সাফিক্স এর সেট থেকে অন্তত একটি সাফিক্স বেছে নিতে হয়, যেটি নেগেটিভ অর্থাৎ নঞর্থক, ক্রিয়ার কালসূচক অথবা লিঙ্গ-বচন-পুরুষসূচক এগ্রিমেন্ট সাফিক্স হতে পারে। এছাড়া ক্রিয়ার মূল রূপটি একটি ডিপেন্ডেন্ট ক্লজ অর্থাৎ অপ্রধান বাক্যাংশের হেড হিসেবে বিবাচিত হওয়ার জন্য একটি নন-ফাইনাইট ভার্বাল সাফিক্সের তালিকা থেকে অন্তত একটি সাফিক্স কে বেছে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India-2011
Droese, Ernest. 1884 Introduction to the Malto Language; Oxford University.
Manna, Samita; & Ghosh, Anita; 2016 Souria Paharia are now in Transition: Beliefs, Rituals and Practices. Research Gate
Puttaswami, C. 2009 Structure of Verbs in Malto; JSAL Vol. 2, issue 1