পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

হাজং সংস্কৃতি

হাজং জনজাতি বোড়ো-কাছারি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এরা তিব্বত মালভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত বর্তমান কিনঘাই উপত্যকা থেকে পরিযানের মাধ্যমে উত্তর-পুর্ব ভারতের ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে। সিডনি এণ্ডেল, অ্যালেন প্রমুখ হাজং জনজাতিকে বৃহত্তর বোড়ো জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। হাজং জনজাতি অসম রাজ্যের নলবাড়ি জেলার অন্তর্গত ‘হাজো’ নামক স্থানকে নিজেদের আদি বাসভূমি বলে মনে করে। এই জনজাতির মধ্যে পাঁচটি পৃথক ক্ল্যান অর্থাৎ গোত্র বর্তমান, যেগুলি হাজংদের নিজস্ব ভাষায় ‘নিকনি’ নামে পরিচিত। এই গোত্রগুলি হলো যথাক্রমে- ‘কোরেবারি’, ‘ডোসকিনা’, ‘সুসুংয়া’, ‘বারোহাজারি’ এবং ‘মেসপারায়া’- অর্থাৎ এই বিষয়টি লক্ষ্যনীয় যে, হাজং জনজাতির বিভিন্ন গোত্র এদের ভাষার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট অর্থাৎ প্রকারগুলি ব্যবহার করে। এদের মধ্যে ‘ক্ল্যান এণ্ডোগ্যামি’ প্রচলিত; অর্থাৎ একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত পুরুষ ও মহিলার মধ্যে বিবাহসম্পর্ক অনুমোদন করা হয় না। হাজং সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, তবে এদের মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজং সমাজ পিতৃতান্ত্রিকতার দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। বিবাহের সময় একটি ন্যুনতম অর্থমূল্য কন্যাপণ হিসেবে দেওয়ার রীতি থাকলেও সেই অর্থে পণপ্রথার ব্যপকতা নেই। হাজং সমাজে বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্ন মহিলাদের পুনর্বিবাহের অধিকার স্বীকৃত। এই প্রকার বিবাহ হাজং ভাষায় ‘হাঙ্গা’ অথবা ’সাঙা’ নামে পরিচিত।

পুর্বে এরা অ্যানিমিজম এবং টোটেম উপাসনায় বিশ্বাসী থকলেও হিন্দুধর্মের জনপ্রিয়তার কারণে বর্তমানে মূর্তিপূজাও প্রচলিত। হাজং জনজাতির বাড়িগুলিতে প্রয়োজন অনুসারে পৃথক ঘর থাকে। ‘ভাট ঘর’ (ডাইনিং ও শোবার ঘর), ‘আখলি ঘর (রান্নাঘর), ‘কাসরি ঘর’ (অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট), ‘গুলিঘর’ (গবাদি পশুর ঘর), ‘দিয়াও’ ঘর (উপাসনার ঘর) ইত্যাদি একটি বৃহৎ উঠোনকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়। ঘরগুলির দেওয়াল বাঁশ এবং মেঝে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়।

হাজং জনজাতির মধ্যে নিজস্ব কিছু ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে ‘বীরাপাট ছিতা’ উল্লেখযোগ্য। এই ঐতিহ্য অনুসারে বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় বিয়ের কনে নিজের বাড়ির দেওয়ালে চিত্র এবং আল্পনা অঙ্কন করে। এই প্রথা অনুসারে চালের গুঁড়ো দিয়ে সূর্য, চন্দ্র, নৌকা ইত্যাদি আঁকা হয়। হাজং জনজাতির নিজস্ব দেবতা ‘কানি-দিয়াও’ এর উপাসনা অর্থাৎ ‘মারোই পূজা’র সময়ও বাড়ির দেওয়ালে ছবি আঁকার প্রথা রয়েছে। এছাড়া কাগজ কেটে দেওয়ালে ঝুলিয়ে ঘর সাজানোর প্রথাও হাজং জনজাতির মধ্যে বর্তমান। হাজং জনজাতির বেশ কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ নিজস্ব উৎসব রয়েছে। এই ধর্মীয় উৎসবগুলি সাধারণত ‘দাওসি’ অথবা ‘নুংতাং’ নামে হাজং সমাজের নিজস্ব পুরোহিতের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত ‘চোরখিলা’ উৎসব হাজংদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এছাড়া প্রতি বছর বর্ষার পূর্বে ‘বিশ্ব’ নামে বিশেষ উৎসব পালন করা হয়। এছাড়া হাজং সমাজ বেশ কিছু অশুভ আত্মার উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে, যেমন- ‘মাচাং-দিয়াও’, ‘জারাং দিয়াও’, ‘জুগনি দিয়াও’ ইত্যাদি। এদেরও উপাসনার প্রথা হাজং সমাজে বর্তমান। এছাড়া বাস্তু বা গৃহদেবতার পূজার সময় কচ্ছপ বা পায়রা উৎসর্গ করার প্রথা রয়েছে।

তবে ক্রমবর্ধমান হিন্দুধর্মের প্রভাব হাজং জনজাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলা, অসমিয়া প্রভৃতি ভারতীয়-আর্য ভাষার প্রভাবে এদের ভাষার নিজস্ব সিনো-তিব্বতীয় প্রকৃতি বিনষ্ট হয়েছে। এদের ভাষিক ঐতিহ্য প্রধানত মৌখিক; নিজস্ব লিপির অভাবে এই ভাষিক বৈশিষ্ট্যগুলির যথাযথ সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। অসমীয়া, হিন্দি, বাংলা ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার শব্দ হাজং ভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারে অতিমাত্রায় প্রবেশ করেছে। হাজং ভাষার ক্রমবর্ধমান ইন্দো-ইউরোপীয় চরিত্রের কারণে ভাষাটি ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিল অনুসারে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকাতেও ভাষাটির স্থান হয়নি। বাংলাদেশের সিলেটের পার্বত্য অংশে এই ভাষার আংশিক প্রচলন থাকলেও সরকারি ভাষা বাংলার উপস্থিতির কারণেও সেখানেও ভাষাটির যথেষ্ট প্রসার ঘটেনি।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Choudhuri, A. K. 2018; Hajong- A Study in Relation to Assamese and Bengali;Journal of Arts, Humanities and Social Science

Guts, Liza. 2012; Phonological Description of the Hajong Language; Cambridge University Press

Hajong, A. & Philips, D. 2008; Hajong-English Phrase Book; SIL International

Kidwai, A. 2019; Hajong Language is not Bangla (Nor is Chakma or Rajbangshi);www.raiot.in