দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল তৎকালীন অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুর জেলাকে ভেঙে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সৃষ্টি হয়। এই জেলার পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্তে বাংলাদেশ, উত্তরে উত্তর দিনাজপুর জেলা এবং পশ্চিমে মালদহ জেলা অবস্থিত। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানের কারণে এই জেলায় বাংলাদেশ থেকে উদবাস্তু অনুপ্রবেশের সমস্যাটি বেশ গভীর। মূলত দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল; ব্রাহ্মণী, আত্রেয়ী, পুনর্ভবা ও টাঙ্গন নদীর উপর নির্ভর করে এই জেলার মানুষ মৎস্যশিকারের মাধ্যমেও জীবিকা নির্বাহ করেন। সুযোগ্য শ্রমিক ও পরিকাঠামোর অভাব দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের বিকাশের অন্তরায়। এই জেলার মোট আয়তন ২১৬২ বর্গকিমি এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জেলার মোট জনসংখ্যা ১৯৭৬২৭৬ জন এবং জনঘনত্ব ৯১০ জন/বর্গকিমি।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা; তবে সুরজাপুরী নামে একটি ভাষা প্রকার এই জেলায় ব্যবহৃত হয়, যা ভারতীয় আর্য ভাষা পরিবারের পূর্বী শাখার অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষার সঙ্গে কামতাপুরী, বাংলা, অসমিয়া ও মৈথিলি ভাষার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ভাষাটির নিজস্ব কোনো লিপি নেই, লেখার কাজে বাংলা ও দেবনাগরী লিপি ব্যবহৃত হয়। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল, মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা থেকে পরিযানের মাধ্যমে সাঁওতাল, ওঁরাও ও মুণ্ডা জনজাতি দক্ষিণ দিনাজপুরে বসতি গড়ে তোলে। সাঁওতালি ভাষা একটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাবংশের অন্তর্গত ভাষা যার নিজস্ব লিপি (অলচিকি) এবং লিখিত সাহিত্য বর্তমান। জনজাতির ভাষা হয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি লাভ ও পঠনপাঠনের সুযোগ থাকার দরুণ সাঁওতালি ভাষার অস্তিত্ব সংকটে পড়েনি। ওঁরাও জনজাতির ভাষা হল কুরুখ যা একটি দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা; এই ভাষাও ঝাড়খণ্ডে এবং ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব লিপি ‘তোলং সিকি’ নামে পরিচিত।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জনজাতিগুলির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বর্তমান। গ্রামীণ দিনাজপুর অঞ্চলের তফশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘খন’ নামে লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রচলন রয়েছে। এগুলি মূলত দিনাজপুর অঞ্চলের কথ্য বাংলা ভাষায় লেখা গান, যে গান মৌখিকভাবে বানানো ও গাওয়া হয়, ফলে পান্ডুলিপির অস্তিত্ব নেই। রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়গাথা নিয়ে রচিত ‘নাটুয়া’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গঙ্গারামপুর ও কুমারগঞ্জ ব্লকে ‘সুরজাপুরী’তে রচিত ‘জংগান’ এর প্রচলন আছে। এছাড়া জনজাতিগুলির মধ্যে স্থানীয় কাঠের তৈরী মুখোশপরে ‘মোখা নাচ’ প্রচলিত। পশুপাখি ও দেবতার মুখোশ প্রধানত ব্যবহৃত হয়। কুশমন্ডি ব্লকে মোখানাচের মূল কেন্দ্রটি অবস্থিত। এছাড়া ‘হালনা-হালনানি’ নামে একপ্রকার ফোক-অপেরা প্রচলিত। এই সমস্ত লোকশিল্পীদের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে জনসচেতনতার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা ভাষিক ও জনজাতির লোকসাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
