পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

ভাইপেই সংস্কৃতি

‘খাও-ভাইপেই’ থিওরি অনুসারে, ‘ভাইপেই’ শব্দটি ‘ফাইজা’ শব্দ থেকে আগত। এটি ছিল আদতে একটি সুয়ান্তাক গ্রাম যা বর্তমান মায়ানমারের চিন পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। এই গ্রামটি আয়তনে বৃহৎ হওয়াতে অধিবাসীরা এই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘খাও ভাইপেই’ রাখে; যার অর্থ ‘বৃহৎ গ্রাম’। ‘খাও ভাইপেই’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ‘খাও’ শব্দের অর্থ গ্রাম, ‘ভাই’ শব্দের অর্থ প্রস্থ এবং ‘পেই’ শব্দের অর্থ সমতল ভূমি। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই গ্রামে বসবাসকারী অধিবাসীরাই এই গ্রামের নামে জনজাতিটিকে পরিচিত করে। বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত এই জনজাতির ভাষায় কোনো স্ক্রিপ্ট বা লিপির অস্তিত্ব ছিল না। ফলে এদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কোনো লিখিত প্রামাণ্য তথ্যের অবকাশ নেই। মৌখিক লোককথা, উপকথা ও লোকসঙ্গীতের মাধ্যমের এদের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক ঐতিহ্য প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়। ভাইপেই জনজাতি ‘খুল’ নামে একটি বিশেষ গুহাজাতীয় স্থানকে তাদের উৎপত্তিস্থল বলে গণ্য করে; যদিও এই ‘খুল’ এর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। এই জনজাতির প্রচলিত লোকগীতিগুলিতেও এই ‘খুল’ এর উল্লেখ রয়েছে।

এরা প্রধানত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল জনজাতি। চিরাচরিত কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তে ঝুমচাষের মাধ্যমে এরা ধান, ভুট্টা, স্কোয়াশ ইত্যাদি উৎপাদন করে। গ্রামে বসবাসকারী ‘থিকসেকপু’ নামক ব্যক্তি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে। ঝুমচাষের জমি যেহেতু পরপর দুই মরসুমের বেশি চাষযোগ্য থাকে না, তাই এরা চাষের উপযুক্ত জমি ও পরিবেশের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিযান ঘটায়। এই জনজাতি গ্রামকেন্দ্রীক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এদের অনেকেরই নিজস্ব কোনো জমি বা উদবৃত্ত ফসলের যোগান থাকে না। এদের মায়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হিসেবে উপরোক্ত বিষয়টিকে দায়ী করা চলে। মেঘালয়, মণিপুর ও মিজোরাম ছাড়া এদের ঘনসন্নিবিষ্ট বসতি অন্য রাজ্যগুলিতে গড়ে ওঠেনি। মণিপুর উত্তর এবং চুড়চাঁদপুর জেলায় ভাইপেই জনজাতির ২২ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। মনে করা হয় যে, পূর্বে ভাইপেই, থাডৌ ও জৌ জনজাতি একত্রেই বসবাস করতো, পরবর্তীকালে বিবাদের কারণে তারা পৃথক হয়ে যায়।

বর্তমানে ভাইপেই জনজাতি খ্রিস্টান ধর্ম অনুসরণ করেছে; তারা বাইবেলও মিজো ও ইংরেজি ভাষা থেকে ভাইপেই ভাষায় অনুবাদ করেছে। সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান এবং গীর্জায় প্রার্থনার সময় ভাইপেই ভাষায় রচিত সঙ্গীতই ব্যবহৃত হয়। মণিপুর রাজ্য ষষ্ঠ শ্রেণি অবধি স্কুলে ভাইপেই ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হলেও অন্য রাজ্যগুলিতে এই ভাষার কোনো সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি। এছাড়া এই জনজাতির পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবেও এই ভাষার স্বীকৃতির বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগের অভাব রয়েছে। ভাইপেই জনজাতি মূলত দ্বিভাষিক; কেবলমাত্র ভাইপেই ভাষা ব্যবহারকারী কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সন্ধান মেলে না। পারিবারিক ক্ষেত্রে ভাইপেই ভাষাতেই এই জনজাতি বাক্যালাপ করে থাকে; কিন্তু সরকারি জায়গায় ও বাড়ির বাইরের স্থানগুলিতে ভাইপেই এর পরিবর্তে মিজো। মণিপুরি, অসমিয়া এবং সর্বোপরি ইংরেজি ভাষা এই জনজাতি ব্যবহার করে।

এদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক; শাসনকার্য, সমাজ পরিচালনা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার- প্রত্যেকটি বিষয়েই ভাইপেই সমাজে পুরুষের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এদের সমাজ অনেকগুলি গোত্রে বিভক্ত; গোত্রগুলি আবার বেশ কয়েকটি উপগোত্রে বিভক্ত। প্রতিটি গোত্রের একজন প্রধান থাকেন, যাকে ‘উপা’ বলা হয়। একএকটি গোত্র একএকটি পৃথক গ্রামে বাস করবে-এমন কোনো নিয়মের অস্তিত্ব ভাইপেই সমাজে নেই; পৃথক গোত্রের মানুষও একই গ্রামে একত্রে বাস করতে পারে। ভাইপেই জনজাতির সামাজিক সংগঠনগুলি ‘তাওমঙ্গাইনা’ নামক নিয়মে চলে, যার অর্থ হলো, সমাজজীবনে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করবে এবং এর পরিবর্তে ব্যক্তি হিসেবে সমাজের কাছে তার কোনোরকম প্রত্যাশা থাকবে না। এই সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের মর্যাদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়া হয়, ছোটরা কখনোই বড়োদের নাম ধরে ডাকতে পারে না। বড়োদের সম্বোধন করার ক্ষেত্রে কতকগুলি উপসর্গ সম্বোধনসূচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন- ‘উ’ অর্থাৎ বড়ো ভাই বা বোন, ‘পা’ অর্থাৎ বাবা বা কাকা, ‘পু’ অর্থাৎ ঠাকুরদা, ‘পি’ অর্থাৎ ঠাকুরমা, ‘নি’ অর্থাৎ কাকিমা ইত্যাদি। পরিবারের প্রধান হন একজন পুরুষ যাকে ‘ইন-খাট-পা’ বা ‘ইন-নেই-কা’ বলা হয় যার অর্থ পরিবারের প্রধান। স্ত্রী স্বামীকে সম্মানার্থক ‘উ’ শব্দ ব্যবহার করে সম্বোধন করে, কিন্তু কখনোই নাম উচ্চারণ করে না। এদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথার প্রচলন রয়েছে। সম্পত্তির উপর পরিবারের মেয়েদের কোনো উত্তরাধিকার স্বীকৃত নয়, যদিও কন্যার পিতা বিবাহের সময় উপহার হিসেবে তাকে জমি দিতে পারেন। পিতৃগৃহের সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বাবার পর পরিবারের বড়ো ছেলের হাতে আসে। মেয়েরা পরিবারের রান্না ছাড়াও কাষ্ঠসম্পদ সংগ্রহ, শিশুপালন, গবাদি পশুর দেখাশোনা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে।

শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার নামকরণ করা হয়। নামকরণের অনুষ্ঠানটি শিশুর জন্মের সাতদিন পর অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য ‘থিয়াম্পু’ নামে গ্রামের নির্দিষ্ট পুরোহিতকে ডাকা হয়। নামকরণের ক্ষেত্রে পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে একটি নিয়ম অনুসরণ করা হয়। ঠাকুরদার নামের শেষ অক্ষরটি শিশুর নামের প্রথম অক্ষর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে আবার দাদু বা দিদা অর্থাৎ মায়ের বাবা অথবা মায়ের নামের শেষ অক্ষর শিশুর নামের প্রথমে বসে। ভাইবেই সমাজে আন্তর্গোত্র বিবাহের প্রচলন আছে। এদের সমাজে একগামীতাই স্বীকৃত, যদিও কিছু বিত্তশালী মানুষের মধ্যে বহুগামীতার প্রবৃত্তিও লক্ষ্য করা যায়। বিধবাদের পুনর্বিবাহের অনুমোদন ভাইপেই সমাজ দিয়ে থাকে, যদিও বিবাহবিচ্ছেদ সাধারণত স্বীকৃত নয়। বিবাহ প্রধানত চার প্রকারের হয়, ‘চায়োংমো’ অর্থাৎ সম্বন্ধ করে বিবাহ, ‘সাইনাপুয়া’ অর্থাৎ অনুমতি ছাড়া গোপনে বিবাহ, ‘থেপথাক’ অর্থাৎ বলপূর্বক বিবাহ এবং ‘কিগাইসাক’ অর্থাৎ সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া বিবাহ। শেষোক্ত বিবাহটিকে ভাইপেই সমাজে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই জনজাতি নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হলেও পার্শ্ববর্তী মিজো, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা ও অসমিয়া ইত্যাদি সরকারি ভাষার উপস্থিতি এই বৈশিষ্ট্যগুলির ক্রমাগত অবনমন ঘটিয়ে চলেছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Singh, C.Y. 2014 The Linguistic Situation in Manipur; Linguistics of the Tibeto-Burman Area.

Soilalsiam. 2009. Changing Vaipei Society: A Geographical Study; Ph.D thesis submitted at the Department of Geography, North-Eastern Hill University