বাংলা ভাষা
বাংলা, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা দলের অন্তর্গত ইন্দো-ইরানীয় শাখার ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর একটি ভাষা।বর্তমানে বিশ্বে ২২.৮ কোটি বাংলাভাষী যার মধ্যে ভারতবর্ষে ১২.১ কোটি (২০১১ সেনসাস) তথা পশ্চিমবঙ্গে ৭.৮ কোটি বাংলাভাষী বসবাস করেন। ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং অসমে এটি একটি সরকারি ভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং বর্তমানে প্রায় ১০ কোটি বাংলাভাষী এখানে বসবাস করেন।
ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ভাষা বহুল প্রচলিত, এবং বাংলা বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে সপ্তম স্থান অধিগ্রহণ করে আছে। ভারতবর্ষে ২২টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম।
গ্রিয়ারসন(১৯০৩,খন্দ-৫,ভাগ-১) বাংলা ভাষার নামকরণের সম্বন্ধে বলেছেন বঙ্গভূমিতে এই ভাষা ব্যবহারের কারণেই এই নামকরণ। তিনি আরো বলেছেন সংস্কৃতে “বঙ্গ” বলতে “পূর্ব ও মধ্যবর্তী বঙ্গভূমি”কে বোঝানো হত কিন্তু বর্তমানকালে বাংলাভাষী সমস্ত এলাকাকেই “বঙ্গভূমি” হিসেবে গণ্য করা হয়।
চ্যাটার্জী(১৯২৬) বাংলাভাষাকে “মাগধী প্রাকৃত” থেকে অপভ্রংশ হওয়া একটি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি পশ্চিমের উড়িয়া, মাগাহী এবং মৈ্থিলিকে বাংলার সমগোত্রীয় ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং উত্তরপূর্বে অহমীয়া কে বাংলার সমগোত্রীয় ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রসঙ্গত ১৪০০ শতক অবধি বাংলা ও অহমীয়া ভাষায় ভাষাতাত্বিক প্রভেদ সেরকমভাবে লক্ষ্য করা যেত না।(তথ্যঃ বাংলাপিডিয়া)
বাংলা ভাষার বিবর্তনকে প্রধানত ৩ ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। (তথ্যঃ বাংলাপিডিয়া)
১) আদিভাষা (৯০০-১২৫০খ্রিস্টাব্দ) আদি বাংলাভাষা প্রমাণ স্বরূপ “চর্যাপদের” কবিতাগুলিকে গণ্য করা হয়। যদিও সেই কবিতা গুলোয় ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় মাগধী ভাষার সম্পর্ক আছে।
২) মধ্যযুগের বাংলা (১৩৫০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) বরু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” বাংলার মধ্যযুগের একটি আদি রচনা। এছাড়াও এইকালে রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ হয়। বৈষ্ণব পদাবলী এবং চৈতন্য চরিতামৃত এই যুগের মধ্যকালে রচিত হয়। বাংলা ভাষায় পারশি এবং আরবি শব্দের উদ্ভব এই সময়কালে লক্ষ্য করা যায়।
৩) নবযুগ (১৮০০- বর্তমান) বাংলা ভাষায় সংস্কৃত থেকে ঋণ করা(তৎসম এবং তদ্ভব) শব্দের প্রচলন এই কালে। এছাড়াও ইংরেজি এবং অন্যান্য বিদেশী ভাষা থেকে ঋণ করা শব্দ এই সময় বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলা ভাষার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক অন্যান্য ভারতীয় ভাষার প্রভাব স্পষ্ট। অনার্য ভাষাগুলির মধ্যে দ্রাভিডিয়ান ও কোল ভাষার প্রভাব বাংলার ধ্বনাত্বক এবং অনুকার শব্দে দেখা যায়(তথ্যঃ বাংলাপিডিয়া)। চ্যাটার্জী (১৯২৬) বাংলা ভাষায় খাস-কুরা(নেপালী) ভাষার প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বাংলা ভাষার চারটি উপভাষার কথা বর্ণনা করেছেন- রাঢ়, পুন্দ্র বা বারেন্দ্র, বঙ্গ কামরূপ। তিনি রাঢ়, বারেন্দ্র এবং কিছু ক্ষেত্রে কামরূপ উপভাষার কিছু সাদৃশ্যের কথা বলেছেন যা বঙ্গ উপভাষায় অনুপস্থিত। বঙ্গ উপভাষার পূর্বভাগের প্রকারগুলি যেমনঃ সিলেট, কাছার, টিপ্পেরা, নোয়াখালী এবং ছিটাগং-এর মধ্যে ধ্বনিগত এবং শব্দগত কিছু পার্থক্য দেখা যায় যা অন্যান্য প্রকারে দেখা যায় না।
সেন(১৯৩৯) বাংলাভাষার পাঁচটি উপভাষার কথা বর্ণনা করেছেন। রাঢ়ী, বঙ্গালী, কামরূপী, বারেন্দ্রী, এবং ঝারখন্ডী। বর্তমানকালে “রাঢ়ী” উপভাষাকেই “মান্য বাংলা” হিসেবে গণ্য করা হয়।
“বঙ্গালী” উপভাষার মধ্যে এখনো মধ্যযুগীয় বাংলার বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায় যা “রাঢ়ী” বাংলায় বিলুপ্ত।
বাংলা কথ্য এবং লেখ্য ভাষার দুটি প্রকার সাধুভাষা এবং চলিত ভাষা। সাধুভাষায় ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলোকে খানিকটা সহজ করেই চলিতভাষার উৎপত্তি। যেমন সাধুভাষার “করিয়া” চলিত ভাষায় “করে”, “সহিত”> “সাথে” ইত্যাদি।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষার প্রচলন শুরু হয়। প্রথমদিকে শুধুমাত্র কথ্য ভাষাতেই চলিত বাংলার ব্যবহার করা হত। সাহিত্যচর্চা, সংবাদপত্র এবং সরকারী কার্যে সাধুভাষার প্রয়োগ করা হত। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সংবাদপত্রে চলিতবাংলার ব্যবহার শুরু হয়। চলিতভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রচলনও বিংশ শতাব্দীতেই তবে সাধুভাষার ব্যবহার বর্তমানে সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত নয়। (তথ্যঃ বাংলাপিডিয়া)
বাংলা ভাষায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ, ৩৯টি ব্যাঞ্জনবর্ণ, এছাড়াও যৌগিকস্বর এবং যুক্তাক্ষরের ব্যবহার প্রবল।
বাংলা ভাষার বাক্যগঠন সাধারণত কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া। অর্থাৎ আমি ভাত খাই কিন্তু চলতি বাংলা এই বাক্যগঠনে সীমাবদ্ধ নয়। যেমনঃ ভাত খাই আমি বা ভাত আমি খাই সাধারণ কথোপকথনে ব্যাকরণগত ভাবে ভুল নয়।
অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের অনেক মিল পাওয়া যায়। এই ভাষাতে পদপ্রকরণ পাঁচপ্রকার বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ৪।অব্যয় এবং ক্রিয়া। বিশেষ্যর রূপভেদ তিন প্রকার, লিঙ্গ, বচন এবং, কারকবিভক্তি। ক্রিয়ার রূপভেদ পাঁচ প্রকার, কাল, ভাব, প্রকার, বাচ্য এবং পুরুষ।
গ্রন্থপঞ্জী :
Bangla Language - Banglapedia. (2015, March 31 ). Retrieved April 29, 2020, from National Encyclopedia of Bangladesh: "http://en.banglapedia.org/index.php?title=Bangla_Language&oldid=20461" Chatterjee, S. K. (1926). The Origin and Development of the Bengali Language. Calcutta: Calcutta University Press.
Encyclopaedia Britannica, I. (2017, July 28 ). Bengali language. Retrieved April 25, 2020, from Bengali language -- Britannica Online Encyclopedia: https://www.britannica.com/topic/Bengali-language.
Grierson, G. A. (1903). Linguistic Survey of India, VOL-5,Part-1. Calcutta: Office of the Superintendent of Goverment Publication.
Sen, S. (1939). Bhashar Itibritto. Barddhaman Sahitya Sabha.