পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

লেপচা সংস্কৃতি

লেপচা জনজাতি দার্জিলিং পাহাড় ও সিকিম রাজ্যের প্রাচীনতম ও আদিমতম অধিবাসী। লেপচা ভাষার নিজস্ব শব্দে এই ভূমি ‘মায়েল ল্যাঙ’ বা ঈশ্বরের বাসভূমি নামে পরিচিত। ‘লেপচা’ এই শব্দটির উৎস সম্পর্কে তিনটি পৃথক মত রয়েছে। প্রথম মতানুসারে নেপালী জাতির মানুষ এদের প্রথম ‘লেপচা’ অর্থাৎ দুশরিত্র (vile) নামে অভিহিত করে। দ্বিতীয় মতটি হলো, নেপালে ‘লাপচে’ নামে একপ্রকার মাছ পাওয়া যেত যেটি চারিত্রিকভাবে লেপচা জনজাতির মানুষের মতোই নমনীয়। তৃতীয় ও শেষ মত অনুযায়ী, লেপচা শব্দটি ‘লেপ’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘জনমগুহা’ (well of procreation)। লেপচারা নিজেদের ‘রং’ অথবা ‘রংকাপ’ নামে অভিহিত করে, যার অর্থ ‘প্রাণের দেবীর আদরের সন্তান’ ( Beloved sons of the Mother of Creation)।

একথা অনস্বীকার্য যে, লেপচা জনজাতির অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনই এদের নিজস্বতার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দার্জিলিং এ নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিপদ্ধতির বিবর্তন ইত্যাদি কারণে লেপচাদের ধর্মীয়, সমাজ-অর্থনীতিগত এবং মনোস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে।

লেপচাদের মধ্যে মূলত স্থানান্তর চাষ প্রচলিত ছিল; ধানচাষের প্রচলন ছিল না। মিলেট জাতীয় শস্যের চাষ ও বাঁশের কাজে লেপচাদের দক্ষতা ছিল। একসময় তারা তিব্বতীয়দের সংস্পর্শে আসে যারা ছিল মূলত ব্যবসায়ী। এই সংস্পর্শ লেপচা জনজাতির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের অন্তরায় হয়ে ওঠে। নেপালীদের সাহচর্যে এরা স্থানান্তর কৃষির পাশাপাশি লাঙল ও কোদালের ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তন কালক্রমে লেপচা অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তারা অরণ্যসম্পদের উপর তাদের স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হারিয়ে ফেলে। অনভ্যাসের দরুণ সাধারণ কৃষিকাজেও তারা নেপালীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে বহিরাগত নেপালী ও তিব্বতিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাধিক্যের কারণে লেপচারা জমির উপর অধিকার হারিয়ে ফেলে। এর সাথে সাথেই লেপচাদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যপূর্ণ দোতলা বাড়ি (উপরের তলা বসবাস এবং নিচের তলা পশুদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো), এবং তাদের নিজস্ব পোশাক (দোম্পা/দোমদাম) এর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। অন্যদিকে বহিরাগত ভুটিয়া এবং নেপালিরা তাদের ঘরবাড়ি ও পোশাকের প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসারী হওয়াতে লেপচা সংস্কৃতি ক্রমশ বিলুপ্তির সম্মখীন হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি যৌথ পরিবার ও গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের ভাঙন ও তার ফলস্বরূপ অনুপরিবারের উৎপত্তি, অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন, খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন (শিকার ও জঙ্গল থেকে উদ্ভিদ আরোহণের পরিবর্তে আধুনিক, সুষম খাদ্যের প্রচলন) ইত্যাদি কারণে লেপচাদের নিজস্বতা হ্রাস পাচ্ছে।

লেপচাদের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর উপাসনা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে দার্জিলিং এর পার্বত্য অঞ্চলে মূলত বৌদ্ধ এবং অংশত খ্রিষ্টান এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাবে লেপচাদের মধ্যে তিব্বতি ও ভুটিয়া ভাষা জনপ্রিয়তা লাভ করে। লাতসুন নামকা জিগমে নামে এক লামা সর্বপ্রথম সিকিম ও দার্জিলিং এর লেপচাদের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের প্রচলন করেন। আজকের দিনেও লেপচা রীতিনীতির অনুসারক ও বৌদ্ধ লামাদের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি গোরে (Gorer) সর্বপ্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে, পার্বত্য অঞ্চলের লেপচা অধিবাসীরা প্রাচীন লেপচা ও তুলনায় নব্য বৌদ্ধ ধর্মের রীতিগুলি (অনেকক্ষেত্রে যা পরষ্পরবিরোধী) একসাথেই অনুসরণ করছে। এর কারণ মূলত দুটি- লেপচাদের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের বিকাশের সময় প্রাক-বৌদ্ধ লেপচা রীতির সঙ্গে বৌদ্ধ আচার ব্যবহারের একটি সমসত্ত্ব সমন্বয় ঘটে যার ফলে সিকিম ও দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার বৌদ্ধধর্ম একটি মিশ্ররূপ পরিগ্রহ করে, যা লেপচা জনজাতির কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, লেপচা মতানুযায়ী যেসমস্ত স্থানগুলি ধর্মীয় কারণে পবিত্র বলে গণ্য করা হতো, পরবর্তী সময়ে সেগুলিকে বৌদ্ধমতেও পবিত্র হিসেবে প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ দান করা হয়। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তাঁরা কখনো প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের জনজাতির উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস বলপূর্বক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না। তার ফলস্বরুপ সুপ্রাচীন লেপচা ধর্মবিশ্বাস ও বৌদ্ধ ধর্মীয় আচারগুলির মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়নি, পরিবর্তে সহাবস্থান বজায় ছিল। দুই প্রকার রীতির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় পার্থক্য রয়েছে। বৌদ্ধ ও লেপচা- দুই মত অনুসারেই মৃত্যুর পর জীবাত্মা মুক্ত অবস্থায় পরিভ্রমণ করে এবং পরিশেষে হারিয়ে যায়। তবে পরিভ্রমণের সময়কাল ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দুই ধর্মে পৃথক মত রয়েছে। বৌদ্ধ মত অনুযায়ী ৪৯ দিন পরিভ্রমণ শেষে জীবাত্মার পুণর্জন্ম ও পৃথিবীতে পুনরাগমন ঘটে। লেপচা মতানুসারে মৃত্যুর পর জীবাত্মা ঈশ্বরের বাসস্থানে (রুম ল্যাং) পৌঁছয়, সেখানে পুণর্জন্মের পর জীবাত্মা শাশ্বত জীবনের অধিকারী হয়। বৌদ্ধ ধর্মের অনুপ্রবেশের ফলে লেপচা রীতিনীতিগুলি ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে; ধর্মীয় বিশ্বাসে উপরোক্ত উদাহরণের ন্যায় মূলগত পার্থক্যগুলি ক্রমশ কমে আসছে। নির্বিচার বৌদ্ধ রীতির অনুপ্রবেশ ও অনুসরণের ফলে লেপচা জনজাতির নিজস্ব রীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ পুরোহিত (মাম এবং বংথিং) দের সংখ্যা হ্রাস ঘটেছে। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়াও দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের লেপচাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বৌদ্ধ রীতির সঙ্গে সুপ্রাচীন লেপচা রীতির সামঞ্জস্য থাকলেও খ্রিস্টীয় অনুশাসন অধিকাংশই সম্পুর্ণ আলাদা হওয়াতে লেপচা ঐতিহ্য ও বিশ্বাসে ভাঙন ঘটছে। একজন লেপচা জনজাতির মানুষ যদি ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হন, তাহলে ক্যাথলিক চার্চ তাঁর লেপচা জনজাতির নিজস্ব বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানের অধিকার হরণ করে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী লেপচাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার হারও তুলনামূলকভাবে অধিক। বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা বেশি হওয়ায় খ্রিস্টান লেপচাদের মধ্যে মিশ্ররুক্তের আধিক্যও লক্ষ্যণীয়। এভাবে বহিরাগত দুটি ধর্ম- খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ লেপচাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করছে।

অসবর্ণ বিবাহ এবং ভিন্নতর ভাষার মানুষের সাথে লেপচাদের বিবাহসম্পর্ক স্থাপনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার কারণে উত্তরপ্রজন্মের শিশুরা মাতৃভাষা হিসেবে লেপচার পরিবর্তে অন্য সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ভাষাকেই গ্রহণ করছে। লেপচাদের বিনম্রতা ও নিজ ভাষাগত ঐতিহ্যের সম্পর্কে হীনমন্যতাই এর মূল কারণ। এভাবে লেপচা ভাষাভাষী শিশু-সংখ্যার গাণিতিক হ্রাস লেপচা জনজাতির ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Devy, G. N. & Pandey, Balaram. THE LANGUAGES OF SIKKIM, People’s Linguistic Survey of India. Orient Blackswan, 2017.

Grierson, G.A. Linguistic Survey of India Vol 3, Part 1. Motilal Banarasidas, 1967.

Census of India -1931, 2011.

Singh, K.S.et al. People of India, Sikkim, Anthropological Survey of India. Seagull Books, 1993.

Tamsang, K.P. The Unknown and Untold Reality about the Lepchas. Mani Printing Press. 1998.

Pradhan, Alina. Language Movement in the Darjeeling Himalayas: Special Reference to the Lepcha Language. LANGUAGE IN INDIA, 2012.

Subba, Tanka.B. The Lepchas: From Legends to the Present Day. RELIGION AND SOCIETY, 1985