মেচ ভাষা
মেচ জনজাতি ‘বোড়ো-কাছারি’ শাখার অন্তর্ভুক্ত একটি জাতিগোষ্ঠী যারা নেপাল, ভারতের আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বসবাস করে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসা ভারতে এই জনজাতির মানুষের সংখ্যা ৫১১২৫; যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ৩১২৪২ জন এবং আসাম রাজ্যের অধিবাসী ৯৮৮৩ জন। উভয় রাজ্যেই এই জনজাতির মানুষ তফশিলি উপজাতি তালিকাভুক্ত। অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যাকায় যে জনজাতি ‘বোড়ো’ নামে পরিচিত, তারাই উত্তরবঙ্গে মেচ এবং নেপালে ‘মেচি’ নামে পরিচিত। এণ্ডেল (১৯১১) এর মতে, আসামে হিন্দুরা নিজেদের কাছারি নামে পরিচয় দেয়; বাংলায় তারাই মেচ নামে পরিচিত। এডওয়ার্ড ডালটন (২০১৬) এর মতে, মেচ ও কাছারিরা সমগোত্রীয়। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু বোড়ো জনগোষ্ঠীই মেচ নামে পরিচিত, তাই মেচ ভাষা বলতে উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত বোড়ো ভাষার প্রকারভেদ বোঝায়।
কাজুয়ুকি কিরুয়ু তাঁর An Outline of the Mech Language-grammar, text and glossary (2005-2007) শীর্ষক একটি প্রোজেক্ট রিপোর্টে বোড়ো ভাষার পশ্চিমা প্রকারভেদটিকেই মেচ নামে অভিহিত করেছেন। গবেষকরা বিভিন্ন সময় বোড়ো ভাষার আলোচনা অসম রাজ্যের মধেই সীমাবদ্ধ রাখলেও উত্তরবঙ্গের মেচ ভাষার আলোচনা ছাড়া তা কখনো সম্পুর্ণ নয়। গ্রিয়ারসন (১৯০৩) ও এণ্ডেল (১৯৯৭) এর মতে, ‘মেচ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছে যার আভিধানিক অর্থ ‘অস্পৃশ্য’। গ্রিয়ারসন এর মতে, আসামের কামরূপ জেলার পশ্চিমভাগে বসবাসকারী বোড়ো গোষ্ঠীর মানুষদের তাদের হিন্দু প্রতিবেশীরা ‘মেচ’ নামে অভিহিত করেন। বীরহাস গিরি বসুমাতারি তাঁর গবেষণাপত্র Boro Dialects of Brahmaputra Valley: A Linguistic Study (২০০৬) এ উত্তরবঙ্গ ও নেপালের বোড়ো ভাষার প্রকারভেদটিকে ‘মেসা’ নামে অভিহিত করেছেন।
সান্যাল (১৯৭৩) এর মতে, নেপালের মেচি নদীর তীরে যারা বসবাস করত তাদেরকেই মেচ বলা হয়। নেপাল থেকে পরিযানের মাধমে এই জনজাতি ভারতের অসম ও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। মেচ জনজাতি নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে মোঙ্গলয়েড শ্রেনিভুক্ত, গোলাকার মুখ, চ্যাপ্টা নাক, খর্বাকৃতি। এদের ভাষা সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের তিব্বত বর্মীয় শাখার বোড়ো-নাগা উপশাখার অন্তর্ভুক্ত। মেচ ভাষায় ৬টি স্বরধ্বনি ও ১৬টি ব্যাঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাঁর History and Culture of the Bodos (২০১১) বইতে অসমের বোড়ো ও উত্তরবঙ্গের মেচ এর মধ্যে ধ্বনিগত ও রূপগত বৈসাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সান্তালাল মেচি এবং কাজুয়ুকি কিরুয়ু যৌথভাবে সর্বপ্রথম মেচ-নেপালী-ইংরেজি অভিধান প্রকাশ করেন। মেচ জনজাতির মানুষ উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জনজাতির মতোই বহুভাষিক। মেচ সম্প্রদায়ের সার্বিক শিক্ষার হার ২৬.৯৭ শতাংশ- পুরুষ ৩৩.৩৭ শতাংশ এবং মহিলা ১৯.৯৭ শতাংশ। মেচ ভাষার নিজস্ব লিপির অস্তিত্ব নেই; অসমের মেচ অর্থাৎ বোড়ো জনগোষ্ঠি রোমান ও অহমিয়া লিপি ব্যবহার করে। ভট্টাচার্য (২০০৪) দেখিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মেচ জনজাতির সাহিত্য রচনায় বাংলা লিপি ব্যবহৃত হয়।
তিস্তা-তোর্সা উপত্যকা অঞ্চলের অন্যান্য জনজাতি যথা রাভা, গারো, ওঁরাও, লেপচা লিম্বুদের মতোই অন্যতম প্রধান জনজাতি হল মেচ। এদের সাহিত্য মূলত মৌখিক ও লৌকিক। নিজস্ব লিপির অভাবে লিখিত সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব হয়নি। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেচ জনজাতির মধ্যে আধুনিক ইংরাজি শিক্ষার প্রসার ঘটে। ১৮৯১ থেকে ১৯৯১- এই একশো বছরে মেচ জনজাতির মানুষের সংখ্যার কেবলমাত্র হ্রাস ঘটে। বৃটিশদের জঙ্গল অধিকার করে নিয়ে চা বাগানের সম্প্রসারণ, জমি নীতির পরিবর্তন, বহিরাগতদের আগমন ইত্যাদি ছিল জনসংখ্যা হ্রাসের মূল কারণ। মানুষের সংখ্যা কমতে থাকায় মেচ জনজাতির নিজস্ব রীতিনীতি ও ভাষাগত বৈচিত্র্যগুলি বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়। ইউনেস্কোর বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষার তালিকায় মেচ ভাষাকে ‘severely endangered’ শ্রেনিভুক্ত করা হয়েছে। অসমের ‘প্যান বোড়ো লিটারারি মুভমেণ্ট’ যা আসামে ‘All Bodo Sahitya Sabha’ নামক সংগঠন শুরু করে, পশ্চিমবঙ্গের মেচরা তার সমান্তরালভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেচ মাধমে লেখাপড়ার সু্যোগের দাবি তোলেন।
গ্রন্থপঞ্জী :
Kiruyu, Kajuyuki. An Outline of the Mech Language-grammar, text and glossary (2005-2007).
Basumatary, Birhas Giri. Boro Dialects of Brahmaputra Valley: A Linguistic Study. 2006.
Mandal, Satyendranath. History and Culture of the Bodos. 2011
Census of India- 2011, 1991.
Grierson, G.A. Linguistic Survey of India, Matilal Banarasidas, 1903.