চামলিং ভাষা
চামলিং ভাষা সিনো-তিব্বতিয় ভাষা বংশের দক্ষিণ কিরান্তি শাখার একটি ভাষা যা মূলত নেপাল, ভূটান ও ভারতে প্রচলিত। এই ভাষাটি ‘চামলিঙ্গে’ এবং ‘রোদাং’ নামেও পরিচিত। কিরান্তি ভাষা শাখার বানতাওয়া ও পুমা ভাষার সাথে এই ভাষাটি নিকট সম্পর্কে আবদ্ধ। এই ভাষার মূল শব্দক্রম হল কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মূল বাসস্থান হলো নেপাল যেখানে এদের সংখ্যা ৭৭০০০। পশ্চিমবঙ্গে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম। এই ভাষা লেখার কাজে দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করা হয়।
চামলিং ভাষার ইতিহাস প্রায় দক্ষিণ এশিয়ায় ঋক-বৈদিক যুগের সমতুল্য-প্রায় ৩৫০০-৫০০০ বছরের পুরোনো। কিরান্তি ভাষা শাখার ‘মুন্ধুম’ নামক ধর্মীয় গ্রন্থ, যা ‘কিরাত মুন্ধুম’ নামক ধর্মের ভিত্তি, তা চামলিং চাষায় রচিত হয়েছিল। তবে এই গ্রন্থের ভাষা কথ্য চামলিং ভাষার থেকে পৃথক। প্রধানত নেপালের ভোজপুর জেলা, খোটাং ও উদয়পর জেলা, এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় এই ভাষার মানুষজন দেখতে পাওয়া যায়। বানতাওয়া ভাষার মতো চামলিং ও একটি বিপন্ন ভাষার তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৪-১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে টি বি রাই লিখিত ‘চামলিং রাই ও চামলিং ভাষা’ হলো এই ভাষায় লেখা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাকরণ ও ভাষাভিত্তিক বই। এই বইতে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের একটি বিস্তারিত তালিকা পাওয়া যায়। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে কারেন এবার্ট লিখিত ‘চামলিং’ বইটিতে সর্বপ্রথম ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীতে চামলিং ভাষার বিস্তৃত পর্যালোচনা করা হয়। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালি-চামলিং-ইংরেজি শব্দকোষ নামে একটি অভিধান লিখিত হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চামলিং ব্যাকরণ নামে একটি ডক্টরেট গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, যা চামলিং ভাষার একটি বিস্তৃত ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব, ক্রিয়া ও বাক্যতত্ত্বের বিস্তারিত আলোচনা।
চামলিং ভাষায় ‘বাইনোমিয়াল’ এর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, যা কেবলমাত্র মুন্ধুমে সীমাবদ্ধ নয়। রোজকার ব্যবহৃত ভাষার মধ্যেও বাইনোমিয়াল এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘কোকমা’ অর্থাৎ ‘ঠাকুরমা’ শব্দটি মুন্ধুমের অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু যখন শব্দটি এই বিশেষ ধর্মীয় ভাষায় ব্যবহৃত হয়, তখন তার অর্থের সম্প্রসারণ ঘটে এবং দেবী অর্থাৎ মহিলা দেবতা বোঝায়। যখনই কোন বিশেষ পদ মুন্ধুমে ব্যবহৃত হয়, তখন তা অপর একটি শব্দের সঙ্গে সন্নিবিষ্ট থাকে। এই দ্বিতীয় শব্দটি সাধারণত কোনো অর্থ বহন করে না। এই ভাষা প্রধানত বৌদ্ধ শ্রমণরা ব্যবহার করে এবং অন্য ভাষার শব্দ চামলিং ভাষায় নিয়ে এসে একটি সৃজনশীল রূপ পরিগ্রহ করে। মৈথিলি ভাষা থেকেও বেশ কিছু শব্দ চামলিং ভাষায় প্রবেশ করেছে। চামলিং ভাষায় ব্যবহৃত বাইনোমিয়ালগুলি প্রধানত চার প্রকার হয়, এরা যৌগিক বিশেষ্য হতে পারে যার প্রতিটি অংশের নিজস্ব অর্থ রয়েছে; কেবলমাত্র পরে যুক্ত হওয়া অংশটিই অর্থবহ হতে পারে, কেবলমাত্র একটি অংশই অর্থবহ হতে পারে, অথবা শুধুমাত্র পরবর্তী অংশটিই অর্থবহ হতে পারে। এই বাইনোমিয়ালগুলি মূলত রিডুপ্লিকেশন এবং আংশিক রিডুপ্লিকেশনের মাধ্যমে গঠিত হয়। এক্ষেত্রে শব্দের প্রথমে অবস্থিত সিলেবলটির আংশিক পরিবর্তন ঘটে। শুধুমাত্র শব্দ নয়, পুরো বাক্য বা বাক্যাংশেরও রিডুপ্লিকেশন ঘটতে পারে। যেহেতু মুন্ধুম এর সাথে ধর্মীয় অনুষঙ্গ জড়িত, তাই এই ভাষায় টোনালিটি ও মিউজিকালিটি (ধ্বনিময়তা ও সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য) বর্তমান।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India, 2011
Census of Nepal 2011
Chemjong, I.S. “History and Culture of the Kirat”.
European Bulletin of Himalayan Research, Issue 17-19, Sudesien Institut, 1999
Cemjonga, Imana Simha, History and Culture of the Kirat People. Kirat Yakthung Chumlung
Subba, T.B. Politics of Culture: A Study of three Kirata Communities in the Eastern Himalayas.