হমার ভাষা

হমার ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের তিব্বত-বর্মীয় শাখার দক্ষিণ-মধ্য অর্থাৎ সাউথ-সেন্ট্রাল উপশাখার একটি ভাষা, যা মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয়, অসম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ৯৮৯৯৮। মিজোরাম রাজ্যের আইজল এবং চম্ফল জেলা, মণিপুরের ফেরজাওয়াল ও চূড়াচাঁদপূর জেলা, মেঘালয়ের শিলং, ত্রিপুরা রাজ্যের জাম্পুই পাহাড়ের পার্বত্য অংশ, অসমের ডিমা-হাসাও এবং কার্বি-আংলং জেলায় এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ রয়েছেন। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, লেখার কাজে মূলত ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের কিছু নির্দিষ্ট অংশেও হমার ভাষা ব্যবহার করা হয়। ভাষাটিরর পূর্বতন রূপগুলি হলো মনমাসি, নীলাচল, তুকবেমসাম ইত্যাদি। এই ভাষার মান্য প্রকারটি হলো খাওসাক, যা শিলচরে আধুনিক ভারতীয় ভাষা হিসেবে স্নাতকস্তরে পড়ানো হচ্ছে। অন্যান্য কুকি ভাষা যেমন, থাডৌ, সিমতে, গাংতে, পাইতে ইত্যাদির সঙ্গে এই ভাষার আংশিক পারস্পরিক বোধগম্যতা রয়েছে।

ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে হমার ভাষা অন্যান্য কুকিচীন গোত্রের ভাষাকেই অনুসরণ করে। এই ভাষায় ১৮টি ব্যাঞ্জনধ্বনি এবং ৬টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। এই ১৮টি ব্যাঞ্জনধ্বনির মধ্যে ৬টি গ্লটাল স্টপ, ৪টি ফ্রিকেটিভ, ২টি ন্যাসাল এবং ১টি ল্যাটারাল ব্যঞ্জনধ্বনি। এই ভাষায় বিশেষ্যের সঙ্গে বচন ও লিঙ্গের মার্কার যুক্ত হয়। এছাড়া কেস-মার্কার এবং পোস্ট-পোজিশনও বসতে পারে। বিশেষণ, নিউমেরাল অর্থাৎ সংখ্যাবাচক শব্দ, কোয়ান্টিফায়ার ইত্যাদি বিশেষ্যর পরে বসে। এই ভাষার বিশেষ্য পদগুলি মনোমর্ফেমিক বা পলিমর্ফেমিক হয়। বিশেষ্য পদ দুই শ্রেণির হয়- ডিরাইভড ও নন-ডিরাইভড। সর্বনাম হমার ভাষায় দুভাবে বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হতে পারে- মুক্ত অর্থাৎ ফ্রি ফর্ম এবং ক্লিটিক ফর্ম। ফ্রি অর্থাৎ মুক্ত অর্থে ব্যবহৃত সর্বনামটি নিজেকেই সূচিত করে; অপরপক্ষে, ক্লিটিক ফর্মে ব্যবহৃত সর্বনামটি ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট ক্লিটিক মার্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ক্লিটিক ফর্মের সর্বনামগুলি বিশেষ্যের পূর্বে বসে পোজেশন অর্থাৎ অধিকারও বোঝায়। কুকিচীন শাখার অন্যান্য ভাষার মতোই হমার ভাষাতেও জেন্ডার অর্থাৎ লিঙ্গ অর্থের ভিত্তিতে সূচিত হয়। কুকিচীন গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষার মতোই গাংতে ভাষাতেও জেন্ডার অর্থাৎ লিঙ্গ অর্থের ভিত্তিতে সূচিত হয়। জীব শ্রেণির মধ্যে পুংলিঙ্গের সূচক হিসেবে –পা মার্কার ব্যবহার করা হয় এবং স্ত্রীলিঙ্গ সূচক হিসেবে –নু মার্কার ব্যবহার করা হয়। হমার ভাষায় নাম্বার অর্থাৎ বচন তিন প্রকার- একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। একবচনের ক্ষেত্রে কোনো মার্কার ব্যবহার করা হয় না; দ্বিবচনের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বা সর্বনামের পর সাফিক্স হিসেবে ‘দুই’ এই নিউমেরিকাল অর্থাৎ সংখ্যাবাচক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বহুবচনের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বা সর্বনামের পর –তে মার্কার ব্যবহার করা হয়। কেস অর্থাৎ কারক সম্পর্কগুলি হমার ভাষাতে বিশেষ্যের পর শেষ অংশে পোস্টপোজিশন হিসেবে আসে। এই ভাষাতে সাবজেক্ট-ভার্ব এগ্রিমেণ্ট দেখা যায়, অর্থাৎ, উত্তম, মধ্যম ও প্রথম এই তিন পুরুষেই কর্তার সঙ্গে ক্রিয়ার এগ্রিমেন্ট দেখতে পাওয়া যায়। হমার ভাষায় বিশেষ্যের ক্লাসিফায়েরেরও প্রয়োগ রয়েছে। এছাড়া রিডুপ্লিকেশন, যৌগিক বিশেষ্য গঠন, ফ্ল্যাট আইটেম, ইলংগেটেড আইটেম ইত্যাদি ভাষার রূপগত বৈশিষ্ট্যগুলি অন্যান্য কুকিচীন ভাষার মতো গাংতে ভাষাতেও উপস্থিত। এই ভাষার সাধারণ পদক্রম হলো কর্ম-কর্তা-ক্রিয়া, অর্থাৎ এই ভাষায় কর্ম বাক্যের শুরুতে বসে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলির মতো কর্তা বাক্যের প্রথমে বসে না। এই পদক্রম নির্দিষ্ট, কোনভাবে এর ব্যাতিক্রম ঘটলে বাক্যের অর্থ হারিয়ে যায়। বর্তমানে মণিপুর রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে এই ভাষা পড়ানোও হয়। এছাড়া মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় হিসেবে হমার ভাষা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে ভাষাটির চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। মণিপুরি এবং মিজো ভাষার মতো হমার ভাষাতেও দূরত্বের সূচক হিসেবে ‘স্প্লিট ডিটারমিনার’ ব্যবহার করা হয়। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যার জন্য গাংতে ভাষায় মোনোমর্ফেমিক শব্দ ব্যবহৃত হয়; ১০ এর পর থেকে যৌগিক শব্দগঠন আরম্ভ হয়।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India- 2011

Haokip, Pauthang. 2009. Noun Morphology in Kuki-Chin languages; Language in India Hmar; www.ethnologue.com

Ramthienghlim, T. 2015; Language Loss and Maintenance within the Hmar Tribe; www.academia.edu

Singh, C.Y. 1995; The Linguistic Situation in Manipur. Linguistics of the Tibeto-Burman Are