বর্তমানে মাহালি জনজাতির মানুষের মূল জীবিকা বাঁশের কাজ; এরা মূলত কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ‘মাহালি’ নামটি দুটি পৃথক শব্দ থেকে এসেছে; ‘মাহ’ অর্থাৎ বাশ, এবং ‘আলি’ অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ। ডালটন (১৯৮৭, ৩২৬) এর মতে, সাঁওতালদের যে শাখাটি বাঁশের কাজে পারদর্শী হয়ে কালক্রমে সাঁওতালদের থেকে জীবিকার ভিত্তিতে পৃথক হয়ে যায়, তারাই মাহালি নামে পরিচিত। রিসলে (১৯৮১, ৪০) এর মতে, মাহালিরা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত- বাঁশফোড় মাহালি অর্থাৎ যারা বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করে; পাতর মাহালি অর্থাৎ যারা কৃষিকাজ ও বাঁশের কাজ উভয়ই করে; সালাঙ্কি মাহালি অর্থাৎ যারা কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে; তাঁতি মাহালি অর্থাৎ যারা পালকি বাহকের কাজ করে; এবং মুন্ডা মাহালি, যাদের সুনির্দিষ্ট কোন জীবিকা নেই। মাহালিদের বেশিরভাগই ভূমিহীন, অল্পসংখ্যক মাহালি জনজাতির মানুষের কিছু কৃষিজমির মালিকানা রয়েছে। বাঁশের ঝুড়ি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র এরা মূলত মধ্যস্থ ব্যাক্তির মাধ্যমে শহরে বিক্রি করে জীবনযাপন করে।
মাহালি জনজাতির মানুষ বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত, প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব টোটেম অর্থাৎ উপাস্য দেবতা বর্তমান। মূলত ১৩ টি গোত্র ও তার টোটেমগুলি হল- বাস্কে (লাল নটে শাক), বেসরা (বাজপাখি), হাঁসদা (বুনো হাঁস), হেমব্রম (বাদাম), কিস্কু (মাছরাঙা), মাণ্ডি (নীল চক্র নামে নীল পাখি), মুর্মু (শাল মাছ), সোরেন, টুডু (মেঠো ইঁদুর), ছোরে (গিরগিটি), সামাহ (একপ্রকার ঘাস), পাহিরি (গোল কুমড়ো), খাংগার ( ডোমকাক)। মাহালিরা কয়েকটি গোত্রের জন্য কিছু নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করে, যেমন- ‘মুর্মু’ এর জন্য ডুমরি, ‘কিস্কু’ এর জন্য বিসরা, ‘টুডু’ এর জন্য বারহে, ‘মাণ্ডি’ এর জন্য মারডি, ’সোরেন’ এর জন্য কাউরিয়া ইত্যাদি। প্রতিটি গোত্র কতকগুলি উপগোত্রে বিভক্ত। উপগোত্রগুলি ‘খুঁট’ নামে পরিচিত। মাহালিদের মধ্যে সমজাতির মধ্যে বিবাহ এবং গোত্রগুলির মধ্যে বিবাহ অর্থাৎ আন্তর্বিবাহ প্রচলিত। মাহালি সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত নেই।
মাহালি সম্প্রদায়ের বাড়িগুলি ‘ওরাক’ নামে পরিচিত। মাহালিদের মধ্যে অনুপরিবার প্রচলিত। পরিবারের প্রধানের মৃত্যুর পর সম্পত্তির মালিকানা মৃতের পুত্র ভোগ করে। মাহালি সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, এখানে বিয়ের পর মেয়েরা ছেলের বাড়িতে বসবাস করে। সাধারণত বিয়ের পর বর-বউ এর বসবাসের উদ্দেশ্যে একটি নতুন গৃহনির্মাণের প্রচলন রয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে বিবাহের পরেই পুত্রের আলাদা থাকবার প্রবণতার জন্যই মাহালি জনজাতির মধ্যে যৌথ পরিবাব অত্যন্ত সীমিত সংখ্যায় রয়েছে।
মাহালিদের নিজস্ব সামাজিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে সামাজিক রীতিনীতিগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও সামাজিক অনুশাসন বজায় রাখা হয়। পঞ্চায়েতের প্রধান ‘মুখিয়া’ অতবা ‘পরগণাইত’ নামে পরিচিত। অন্যান্য পদগুলি হল পারনিক, গুরিত, পূজারী অথবা নাইক এবং পা্রগানা। গুরিত বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে, নাইক দেবতার উপাসনা করে, পারনিক মুখিয়ার কাজে সহায়তা করে, পারগানা মানুষের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পর তার হাড়গুলিকে নদীর জলে বিসর্জন দেওয়ার কাজ করে। ঝগড়া-বিবাদ, বিবাহ ও বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি মুখিয়া অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার মাধমে নিয়ে থাকেন।
মাহালিরা অন্যান্য জনজাতির মতোই জীবজন্তু ও উদ্ভিদের পূজায় বিশ্বাসী। মাহালিদের গৃহদেবতা হলেন ওরাক বোঙা, যার পূজাপদ্ধতি বিভিন্ন গোত্রের ক্ষেত্রে পৃথক। মাণ্ডি গোত্র সাদা মোরগ উৎসর্গ করে থাকে, মুর্মুরা লাল রঙের এবং বাস্কে গোত্রের মাহালিরা মিশ্র রঙের মোরগ উৎসর্গ করে থাকে। হেমব্রম গোত্রের মাহালিরা উত্তর দিকে মুখ করে মোরগ উৎসর্গ করে, অপরদিকে হাঁসদা গোত্রের মাহালিরা পূর্বদিকে মুখ করে উৎসর্গ করে। মাহালিদের প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন বড়পাহাড়ি দেও এবং মনসা দেবী। এরা মূলত টোটেম উপাসনা করলেও বর্তমানে মাহালিদের মধ্যে হিন্দু, খ্রিষ্টান, মুসলিম, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্ম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মাহালিদের প্রাচীন উপাস্য দেবতা ধরাম, গরাম ইত্যাদি, গ্রামের প্রাচীন একটি বৃক্ষের নীচে যাদের উপাসনাস্থল এবং এই জায়গাটি অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। মাহালিরা বছরে একদিন একটি নির্দিষ্ট বনের ভিতর তাদের দেবতাদের সমবেত উপাসনা করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাহালিরা বৈশাখ মাসে হরিপূজা ও জৈষ্ঠ্য, শ্রাবণ ও আশ্বিন মাসে মনসা পূজা করে থাকে। ভাদ্রমাসে করম পূজা, পৌষমাসে টুসু পরব, মাঘমাসে আখুনি পূজা এবং ফাল্গুন ও চৈত্রমাসে সরহূল পরব পালিত হয়। সামাজিক পূজাপার্বনে একজন ব্রাহ্মণ অথবা নাইক পৌরহিত্য করেন। বাড়ির পূজাগুলি পরিবারের সর্বাধিক বয়স্থ ব্যাক্তি করে থাকেন।
শিশুর জন্মের নয়দিন পর ‘মুণ্ডন’ নামে একটি রীতি পালিত হয়, যেখানে একজন নাপিত শিশুর চুল কেটে এবং মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নখ কেটে দেন। তারপর মা ও শিশুকে একটি কাছাকাছি পুকুরে গায়ে হলুদ মাখিয়ে স্নান করানো হয়, যা একজন বয়স্থা মহিলা করিয়ে থাকেন। তারপর পূজার মাধ্যমে মা ও শিশুর শুদ্ধিকরণ করা হয়। বাড়ির সামনে গোবর রেখে যেকোন পূর্বপুরুষের নামে শিশুর নামকরণ করা হয় এবং সেদিন খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়। শিশুর বয়স পাঁচমাস পূর্ণ হলে তার অন্নপ্রাশন হয়। শিশুর চার-পাঁচ বছর বয়স হলে ‘সম্মিলন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে মাহালি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাহালি সমাজের বিবাহ ‘বাপলা’ নামে পরিচিত যা ছেলের বয়স ১৮-২২ এবং মেয়ের বয়স ১৬-২০ হলে দেওয়া হয়। জন্মদিন ও মাসে বিবাহের রীতি নেই, ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসেও বিবাহ হয় না। কন্যাপণ হিসাবে ৪৮-৬৪ টাকা ও চারটি শাড়ি দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। কন্যার জন্য দুটি, তার মা ও ঠাকুরমার জন্য একটি করে শাড়ি নির্দিষ্ট। মাহালি সমাজে বিবাহ মূলত সম্বন্ধের মাধ্যমে হয়ে থাকে যেখানে ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হয়। নিকট আত্মীয়রাই ‘রাইবার’ অর্থাৎ ঘটক হিসাবে কাজ করে। প্রকৃত বিবাহের আগে বৌ ও বরকে যথাক্রমে আম ও মহুয়া গাছের সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। সম্বন্ধ করে বিবাহ ছাড়াও পালিয়ে বিয়ে (আঙ্গির), বলপূর্বক বিয়ে (আউরাপার) এবং ‘ঘর-জাওয়াই’ (অর্থাৎ বিয়ের পর ছেলে শ্বশুরবাড়ী এসে থাকে) ইত্যাদি বিবাহের প্রচলন আছে।
মৃত্যুর পর মাহালিরা মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে সৎকার করে; শুধুমাত্র শিশুদের সমাধিস্থ করা হয়। মাণ্ডি ও মুর্মু গোত্র মৃতদেহকে পুর্বদিকে মুখ করে রাখে; অন্যান্য গোত্রের মাহালিরা মৃতদেহকে উত্তরমুখী করে রাখে। সৎকার সম্পূর্ণ হওয়ার পর মৃতের হাড়গুলিকে বাড়িতে এসে একটি তুলসীগাছের নীচে রেখে দেওয়া হয়। সৎকারের পর বাড়িতে ঢোকার সময় লোহা ও আগুন ছুঁয়ে প্রবেশ করতে হয়। পরদিন মৃতের হাড়গুলি নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। দশদিন ধরে অশৌচ পালনের পর নাপিত নখ ও চুল কেটে অশৌচের সমাপ্তি ঘটায়। ব্রাহ্মণের ঘরের ভাত খাওয়ার রীতিও রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মাহালি সম্প্রদায়ের নিজস্ব রীতিনীতি ও সামাজিক ঐতিহ্যের দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। মাহালি সমাজে সাঁওতালি ও অন্যান্য প্রধান জনজাতির রীতিনীতির অবাধ প্রবেশের ফলে মাহালিদের নিজস্বতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাহের ফলে বিশুদ্ধ মাহালি রক্তের সন্তানের সংখ্যাও কমছে। নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে নিজের গোত্রের নাম, উপাস্য দেবতা ও তার সঙ্গে জড়িত উপকথাগুলির চর্চার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। মাহালি ভাষার নিজস্ব কোন লিপি না থাকায় তারা দেবনাগরী লিপির ব্যবহার করে। লিপির অভাবে মাহালি ভাষায় লিখিত সাহিত্যের বিকাশও সম্ভব হয়নি। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার বিকাশের ফলে মাহালিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও ভাষিক ঐতিহ্যের অবনমন ঘটছে। মাহালি ভাষায় পাঠক্রম পশ্চিমবঙ্গে চালু হয়নি। অপরপক্ষে সাঁওতালি ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা পাওয়ায় এবং এই ভাষার নিজস্ব লিপির অস্তিত্ব থাকায় শিক্ষা ও সরকারি সুযোগসুবিধা লাভের জন্য মাহালিরা সাঁওতালি, কুড়মালি ও সাদরি ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে মাহালি ভাষার অভিধান তৈরির কাজ চলছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের মাহালি জনজাতির শিক্ষার হার ৪৭.২ শতাংশ। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যান্য জাতির অনুপ্রবেশ এবং নাগরিক সভ্যতা ও রীতিনীতির প্রবেশের ফলে মাহালিরা তাদের নিজস্ব পোশাক-পরিচ্ছদের পরিবর্তে আধুনিক পোশাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মাহালিদের নিজস্ব উৎসবে তাদের নিজেদের গান ও বাজনা বর্তমানে বাজে না। নিজস্ব জাতিগত বৃত্তি বাঁশের ঝুড়ি তৈরি এখনো বিলুপ্ত না হয়ে গেলেও মাহালি যুবক যুবতীরা অন্যান্য পেশাকেই সম্মানজনক মনে করছেন। শিশুদের মাতৃভাষা হিসেবে মাহালি ভাষা শেখাতেও বাবা-মা আগ্রহী নন। ফলে মাহালিদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায়ও অবিমিশ্র মাহালি শব্দের ব্যবহার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
Soni, Amit. Mahali Culture and Social Change in West Bengal. North Bengal Anthropologist: Volume 4, 2016.
Dey, Arup. A Comparative study about Scheduled Tribes in West Bengal, India. International Journal of Advancements in Research & Technology 4(7) : 11-18, 2015.
Census of India, 2011.
Singh, K.S. The Scheduled Tribes (People of India). Oxford University Press, Delhi. P. 705-709. 1994.
Grierson, G.A. Linguistic Survey of India, Volume 6; Matilal Banarasidas. 1904.