হো ভাষা
হো ভাষা হলো অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর উত্তর-মুন্ডা শাখার একটি ভাষা যেটি হো জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। মূলত ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলায় হো জনজাতির অর্ধেকের বেশি মানুষের বসবাস। এছাড়া দক্ষিণ ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলা, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও জলপাইগুড়ি জেলা এবং ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় হো জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ১৪২১৪১৮ জন। এই ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড রাজ্যে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
হো ভাষা এবং মুন্ডারি ভাষার মধ্যে ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে সাদৃশ্য থাকলেও তাদের আঞ্চলিক পরিচয় ও ব্যবহারকারী মানুষেরা পৃথক। কোনো কোনো গবেষক হো এবং মুন্ডারি ভাষাকে ‘সিস্টার ল্যাঙ্গুয়েজ’ নামেও অভিহিত করেছেন। বর্তমানে হো ভাষায় সরকারিভাবে ‘ওয়ারাং-চিতি’ লিপি ব্যবহৃত হয়; তবে পূর্বে দেবনাগরী, ল্যাটিন, ওড়িয়া এমনকি তেলুগু লিপিও ব্যবহৃত হতো। এই ভাষার অভিধান ও শব্দভাণ্ডার ভাষাটির সঙ্গে পাখি ও পশুদের মূলগত যোগাযোগের সাক্ষ্য বহন করে; যেটি যেকোনো জনজাতির ভাষার ক্ষেত্রেই সত্য। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বিহার সরকার নির্দেশ জারি করে যে, মাতৃভাষা হিন্দি নয় এমন ছাত্র ও শিক্ষক উভয়কেই তাদের মাতৃভাষা চর্চা করার সুযোগ দিতে হবে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের শিক্ষায় হো ভাষায় পঠনপাঠনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই ভাষাটি এখনো সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়নি এবং স্কুলের পাঠক্রমেও ভাষাটিকে স্থান দেওয়া হয়নি। হো ভাষায় কমপক্ষে তিনটি প্রকার রয়েছে, লোহারা, চাইবাসা ও ঠাকুরমুন্ডা। চাইবাসা ও ঠাকুরমুন্ডা প্রকার দুটির মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ পারস্পরিক বোধগম্যতা বর্তমান। অস্ট্রো-এশিয়াটিক গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষার মতো হো ভাষাও ‘ফিউশনাল’ প্রকৃতির, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাসমূহের মতো অ্যানালিটিক নয়।
হো ভাষার বিকাশ সংক্রান্ত পড়াশোনার ক্ষেত্রে এতে তুরতুং আখাড়া ও ঝিঙ্কপানির অবদান অনস্বীকার্য। ‘আদি সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান সংস্থান’ এর সহায়তায় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বই প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘হো হায়াম পাহাম পুতি’। সিন্ধু সুরিন এর পরিশ্রমে ওয়ারাং-চিতি লিপির বিকাশ ও পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ওয়ার-আঙ্কাওয়া’ নামক একটি নতুন লিপি প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জন ডিন নামে একজন মিশনারি সর্বপ্রথম হো ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন আইন চালু হলে হো ভাষা ব্যবহারকারী বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেঙে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা ও পরবর্তীকালে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে বারবার ভাষাটিকে সংবিধানের অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অর্থাৎ ইউ জি সি হো ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদা দিয়েছে এবং সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষায় জনজাতির ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অংশ হিসেবে এটি ৭০তম স্থানে রয়েছে। ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যথাক্রমে ২০টি এবং ৪৪৯টি স্কুলে হো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে এবং প্রায় ৪৪৫০২ জন জনজাতির শিশু এই ভাষায় পড়াশুনো করছে। এছাড়া অল ইণ্ডিয়া রেডিওর কেওনঝোড়, রাউরকেল্লা, কটক ও বারিপদা কেন্দ্র থেকে হো ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। অনুরূপভাবে রাঁচি কেন্দ্র থেকে সপ্তাহে দুদিন হো ভাষায় আঞ্চলিক সংবাদ পরিবেশন করা হয়। হো ভাষায় ‘দস্তুর কোরাং’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা এবং ‘দিয়াং’ নামে একটি অনলাইন জার্নালও প্রকাশিত হয়।
হো ভাষার লিপি অর্থাৎ ওরাং-চিতি তে ৩১টি লিখিত বর্ণ রয়েছে। লাকো বোদরা নামে হো জনজাতির এক পণ্ডিত ব্যক্তি এই লিপির উদ্ভব ও বিকাশ সাধন করেন। হো জনজাতির মধ্যে শিক্ষার হার খুবই নিম্ন; এথনোলগ অনুসারে মাত্র ১-৫ শতাংশ হো জনজাতির মানুষ লেখাপড়া জানেন। এই ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তারা মূলত এই ভাষাই ব্যবহার করেন; খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Anderson (Gregory S. ed.); 2008 The Munda Languages.
Census of India-2011
Ho: A Language of India; Ethnologue. SIL International
Mohanta, Dr. Basanta Kumar; Birth Rituals of the Ho Tribe; The Tribal Tribune
Mohanta, Dr. Basanta Kumar; Rituals and Festivals of the Ho Tribe; The Tribal Tribune Singh, C.P; The Ho Tribe of Singbhum.