পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

বির্জিয়া সংস্কৃতি

বির্জিয়া জনজাতি তাদের নোম্যাডিক, জঙ্গলকেন্দ্রিক জীবনযাপনের জন্য আধুনিক সভ্যতা ও শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। ভারত সরকার এদের Particularly Vulnerable Tribal Groups (PVTGs) এর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। এদের আদি বাসভূমি ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল হলেও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের চা-বাগানগুলিতে পরিযানের মাধ্যমে এরা বসতি স্থাপন করে। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের নিয়মিত দুর্ভিক্ষ এবং অনুন্নত জীবনযাত্রাই এদের পরিযানের অন্যতম প্রধান কারণ। ব্রিটিশ আমলে অন্যান্য আদিবাসী জনজাতির মতো এদেরও জঙ্গল ও বনজ সম্পদের উপর স্বাভাবিক অধিকার অনেকাংশে হ্রাস করা হয়। এর ফলে এরা অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য ক্রমশ বেড়ে চলা চা শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু এই পরিযানের পরেও নতুন জায়গায় তারা নিজেদের জনবসতি স্থাপনে সক্ষম হয়নি। অনুন্নত জীবনযাপনের কারণে এদের মৃত্যুহার অত্যধিক। এই জনজাতির জনবিরলতা এবং নতুন জায়গার সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অক্ষমাতাই এদেরকে পার্শ্ববর্তী জনজাতিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে বসবাসকারী বির্জিয়া জনজাতির মানুষের পক্ষে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি পুনরুদ্ধার করে সেগুলিকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ করে তোলা দুরূহ। বর্তমানে এরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার জন্যও অনেকাংশে সাদরি ভাষা বেছে নিয়েছে। শিক্ষা ও কাজের সুযোগ বেশি থাকায় এদের নতুন প্রজন্মও বির্জিয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ও হিন্দি ভাষার ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে বির্জিয়া জনজাতির যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অংশটি এখনও বসবাস করে তাদের মধ্যে বির্জিয়া সংস্কৃতির ছাপ এখনও কিছুমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। এরা প্রধানত প্রকৃতির পূজারি এবং অ্যানিমিজমে বিশ্বাসী। পৃথিবী, সূর্য, চাঁদ এবং জঙ্গলের উপাসনাও এরা করে থাকে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে এরা পূর্বপুরুষের উপাসনার রীতিও অনুসরণ করতে থাকে। কালক্রমে এদের বেশিরভাগ অংশ বৈষ্ণবধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম এবং মুসলিম ধর্মও অনুশীলন করতে থাকে। এছাড়া হিন্দু ধর্মের শিব, লক্ষ্মী ও দুর্গার উপাসনার রীতিও বির্জিয়া সমাজে প্রচলিত। এইভাবে এরা নিজেদের ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির পরিবর্তে প্রধান ধর্মগুলির রীতিনীতিই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে এই জনজাতির ঘনসন্নিবিষ্ট জনবসতির অভাবই এই পরিবর্তনের পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। তবে এরা এখনও মুণ্ডা জনজাতির প্রধান উৎসবগুলি, যেমন- করম পরব, সারহুল ইত্যাদি পালন করে থাকে।

এদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ হলেও ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের অনুন্নত ল্যাটেরাইট মাটিতে চাষ ভালো হয় না। চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর কারণে বৃষ্টিপাতের অভাব এবং অনুন্নত জলসেচ ব্যবস্থাও এদের কৃষিকেন্দ্রিক জীবনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে এদের মধ্যে অনেকেই সমতলভূমিকে বসবাসের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে বির্জিয়া জনজাতির বেশিরভাগ মানুষের নিজস্ব জমি নেই; অন্যের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ এবং ভাগচাষ এদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। এছাড়া জঙ্গল থেকে বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং শিকারও এদের অন্যতম প্রধান জীবিকা। এছাড়া পশুপালন এবং রেশম চাষের মাধ্যমেও এরা জীবিকা নির্বাহ করে।

এদের বাড়িগুলি মূলত ত্রিভূজ বা চতুর্ভূজ আকৃতির যা কাঠ, বাঁশ এবং মাটি দিয়ে তৈরি। এদের বাড়িতে কোনো জানলার অস্তিত্ব নেই। এদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত নয়, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষই পরিবারের প্রধানের ভূমিকা পালিন করেন। এই সমাজ মূলত মনোগ্যামাস অর্থাৎ একগামী হলেও বহুগামীতার দৃষ্টান্ত একেবারে দুর্লভ নয়। বির্জিয়াদের সমাজ গ্রামীণ, এই সমাজের প্রধান ‘বাইগা’ নামে পরিচিত, যিনি সমস্ত সামাজিক নিয়মনীতির পালনের উপর নজর রাখেন। এদের নিজেদের একটি সংগঠন রয়েছে যা ‘পঞ্চায়েত’ নামে পরিচিত। তবে মহিলাদের এই পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। কেবলমাত্র পুরুষরাই এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। তবে বর্তমানে আধুনিক ব্যবস্থায় বির্জিয়া সমাজের পুরুষ ও নারী উভয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দীতা করতে পারেন।

বির্জিয়া জনজাতির ভাষাটি ভারতের কোনো রাজ্যেই আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। লিপির অভাবে এই ভাষার লিখিত কোনো নিদর্শনের অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়নি। অপ্রতুল জনসংখ্যার কারণে বির্জিয়া জনজাতির নিজস্ব চাহিদা ও সমস্যার বিষয়গুলি সঠিকভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করার ফলে এদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ক্রমশ অবনমন ঘটছে। ফলে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়টি এদের কাছে যথাযথ প্রাধান্য পায় না। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকাতেও এই ভাষা স্থান না পাওয়ার ফলে এই ভাষার সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Anderson, G. 2008. The Munda Languages. New York: Routledge.

BIRJIA DOCUMENTATION; 2016. SPPEL.

BIRJIA; 2018. ENVIS Hub: Jharkhand.

Census of India- 2011

Kaahon; 2018. A new history since migration of a small ethnic tribe, Birjia.