‘বিরহড়’ শব্দটি 'বির’ ও ‘হড়’- এই দুটি মুন্ডারি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, যাদের অর্থ হলো যথাক্রমে জঙ্গল ও মানুষ। এদের মধ্যে কৃষিকাজের প্রচলন নেই। জঙ্গলে শিকার এবং বনজ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া ঘাস থেকে দড়ি তৈরির মাধ্যমেও এরা জীবিকা অর্জন করে। এদের সরকার থেকে পাঠানো সাহায্যের মাধ্যমে কৃষিকাজ ও সমাজবদ্ধ গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করা হলেও এরা জঙ্গলকেন্দ্রিক জীবন পরিত্যাগ করতে পারেনি। বিরহড় জনজাতির মধ্যে দুইটি শ্রেণি বর্তমান- যাদের নির্দিষ্ট কোনো বসতি নেই, তারা ‘উঠলু’ এবং যাদের বসতি রয়েছে তারা ‘জংঘি’ নামে পরিচিত। এদের বসতিগুলি অস্থায়ী প্রকৃতির, এগুলি ‘তাণ্ডা’ নামে পরিচিত। এখানে কমপক্ষে ১২টি শঙ্কু আকৃতির বাড়ি একত্রে থাকে। বাড়িগুলি মূলত জঙ্গলের কাঠ, বাঁশ ও বিভিন্নপ্রকার ঘাস দিয়ে নির্মিত হয়। মাটির তৈরি বাসনপত্র এবং মাটি খোঁড়া ও শিকারে ব্যবহৃত অস্ত্র এদের বাড়িগুলিতে অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম হিসেবে উপস্থিত থাকে।
বিরহড় সমাজ অন্যান্য অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনজাতিগুলির মতোই বেশ কয়েকোটি গোত্রে বিভক্ত। এরা অ্যানিমিজম এবং টোটেম উপাসনায় বিশ্বাসী। এদের গোত্রগুলির নামকরণও এইসব টোটেমের নাম অনুসারে রাখা হয়। এদের প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন সূর্যদেবতা। এছাড়া ‘লোগোবীর’ ও ‘বুধিমাঈ’ নামে অন্য দুই দেবদেবীর উপাসনার প্রথা বিরহড় সমাজে প্রচলিত। এরা অন্যান্য মুন্ডা জনজাতির মতোই ‘দিশুম সেন্দ্রা’ অর্থাৎ শিকার উৎসব পালন করে। এই শিকার উৎসবের সঙ্গে বিশেষ ধর্মীয় অনুষঙ্গও জড়িয়ে আছে। বিরহড় জনজাতির বেশ কিছু নিজস্ব নৃত্যশৈলী রয়েছে, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ডং’, ‘লাগরে’, ‘মুৎকার’ ইত্যাদি। ‘মাদল’, ‘টোমকা’, ‘নাগড়া’ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রও নাচের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এই নাচগুলি প্রধানত সমবেত নৃত্য, অর্থাৎ পুরুষ ও মহিলা একত্রে এই নৃত্যে অংশ নিতে পারে।
এদের মধ্যে ক্ল্যান-এণ্ডোগ্যামি প্রচলিত। একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিবাহ বীরহর সমাজে অনুমোদিত নয়। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক থেকে তিন প্রজন্ম ধরে সম্পর্কহীন এরকম পুরুষ ও মহিলাই পরস্পর বিবাহ করার অধিকারী। বিরহড় সমাজে বিবাহের সময় কন্যাপণ দেওয়ার রীতি আছে। এদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথার অস্তিত্ব নেই। এই জনজাতির সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ এবং বিবাহবিচ্ছিন্ন ও বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহ করার অধিকার স্বীকৃত।
শিশুর জন্মের বেশ কিছুদিন আগে থেকে তার মা কে বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এই সময় তাকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। শিশুর জন্মের জন্য ‘কুম্ভা’ নামে একটি পৃথক ঘর নির্মাণ করা হয় যেটি মুল বাড়ি থেকে পৃথক থাকে। শিশুর জন্মের পর ২১ দিন অশৌচ পালনের রীতি রয়েছে; এই ২১ দিনের পর শিশুর নামকরণ করা হয়। বিরহড় জনজাতির মধ্যে মানুষের মৃত্যুর পর মৃতদেহের মাথা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রেখে সমাধি দেওয়া হয়। শিশু বা অল্প বয়সে কারও মৃত্যু ঘটলে সেটিকে বিরহড় সমাজে অশুভ আত্মার অভিশাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। মৃত্যুর পর দশদিন অশৌচ পালনের পর ‘ডেহুরি’ অর্থাৎ পুরোহিতের উপস্থিতিতে পারলৌকিক কাজ করা হয়।
জঙ্গল অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসের কারণে বিরহড় জনজাতির মধ্যে আধুনিক শিক্ষার হার খুবই কম। এই ভাষাটি পুর্ব প্রজন্ম থেকে উত্তর প্রজন্মে সঠিকভাবে সঞ্চারিত হয় না। সাঁওতালি, মুন্ডারি, হো, সাদরি ইত্যাদি অপেক্ষাকৃত বহুল ব্যবহৃত ভাষার উপস্থিতির কারণে এবং লেখাপড়া ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার অভাবে এই জনজাতির নতুন প্রজন্ম ভাষাটির ব্যবহারে আগ্রহী নয়। ইউনেস্কোর ভারতের বিপন্ন ভাষাসমূহের তালিকায় বীরহর জনজাতির ভাষাটি ‘ক্রিটিকালি এনডেঞ্জারড’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।
Anderson, G.D.S. 2021; Introduction to the templetic verb morphology of Birhor, a Kherwarian Munda Language; ResearchGate
BIRHOR; Scheduled Castes and Scheduled Tribes Research and Training Institute, Bhubaneshwar
Census of India- 2011
Sarkar, S. Birhor: A Sociolinguistic study of Language Endangerment
Vidyarthi, L.P. 1960; The Birhors; in W. Anthony (ed.). Men and Cultures; University of Pennsylvania Press