লোথা ভাষা
লোথা ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের একটি ভাষা, যা মূলত নাগাল্যান্ড রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ওখা জেলায় বসবাসকারী লোথা-নাগা জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। এছাড়া মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অংশে আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে প্রায় ১৭৯৪৬৭ জন মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন। ভাষাটি ‘চিজিমা', ‘চোইমি’, ‘হ্লোতা’, ‘লুথা’ ইত্যাদি নামেও পরিচিত। চিয়াং-চেন-সান (২০১১) এর মতে, এই ভাষার ৭টি প্রকার তথা ডায়ালেক্টের অস্তিত্ব রয়েছে, যেমন- সোংসু, ন্দ্রেং, কুও, কিওন ইত্যাদি। লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া নামক বইতে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন নাগা ভাষাসমূহকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন- পশ্চিমা, পূর্বী ও মধ্য নাগা। লোথা ভাষা এই মধ্য নাগা শাখার অন্তর্গত, যেখানে লোথা ছাড়াও আও, সাংতাম ইত্যাদি ভাষাগুলি রয়েছে। লোথা ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, লেখার কাজে মূলত ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে এই অঞ্চলে আগত খ্রিস্টান মিশনারিরা ল্যাটিন লিপির প্রচলন করেছিলেন।
লোথা ভাষায় মোট ৬টি স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। এই ভাষায় ন্যাসালিটি অর্থাৎ নাসিক্যীভবন বৈশিষ্ট্যটি ফোনেমিক নয়। অন্যান্য সিনো-তিব্বতীয় ভাষার মতো লোথা ভাষা টোনাল। এখানে মোট ৩টি টোন যথা- লো, মিড এবং হাই- এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই তিনটি টোনই ভার্বাল ও নমিনাল অর্থাৎ ক্রিয়া ও বিশেষ্যমূলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে। কেবলমাত্র টোনাল-কনট্রাস্টের ভিত্তিতে পার্থক্য করা যেতে পারে এরকম মিনিমাল পেয়ার ও ট্রিপলেটের অস্তিত্ব লোথা ভাষায় নেই। উইটার (১৮৮৮) সর্বপ্রথম লোথা ভাষার একটি স্কেচ-গ্রামার রচনা করেন। এই ব্যাকরণ লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই রচিত হয়। লোথা ভাষার ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির মধ্যে স্টপ (ওরাল ও ন্যাসাল), অ্যাফ্রিকেট, ফ্রিকেটিভ এবং অ্যাপ্রক্সিমেন্ট ধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া উচ্চারণ-স্থানের ভিত্তিতে এই ভাষায় লেবিয়াল, ডেন্টাল/অ্যালভিওলার, প্যালেটাল, ভেলার ও গ্লটাল- এই কয়েকপ্রকার ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। গ্লটাল স্টপ ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যঞ্জনধ্বনি একটি সিলেবলের শুরুতে অর্থাৎ অনসেট পজিশনে বসতে পারে। গ্লটাল স্টপ কেবলমাত্র সিলেবলের শেষে অর্থাৎ কোডা পজিশনেই বসতে পারে। আইডেন্টিকাল ভাওয়েল সেগমেন্টের কোলেসেন্স অথবা অপর কোনো স্বরধ্বনির পূর্বে অবস্থিত ‘সোয়া’ ধ্বনির এলিসনের কারণে একটি একক সিলেবলের মধ্যে ‘টোন-কন্ট্যুর’ দেখা যেতে পারে। এর ফলে যে নতুন স্বরধ্বনির জন্ম হয়, সেটি ওই টোন-কন্ট্যুরকে জায়গা করে দিতে ফোনেটিক্যালি অপেক্ষাকৃত লঙ ভাওয়েলে পরিণত হয়। শব্দের শেষে অবস্থিত ওপেন সিলেবল অর্থাৎ মুক্তদল অনেকসময় হাই-টোনে শেষ হয় এবং একটি ফ্রেজ অর্থাৎ বাক্যাংশের শেষে একটি গ্লটাল-স্টপ নিয়ে আসে। অর্থাৎ এই গ্লটাল-স্টপটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এটি কোনো বিশেষ মরফিমের ক্ষেত্রে লেক্সিকালি স্পেসিফায়েড হলেও এটি হাই-টোনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবেও পরিগণিত হতে পারে।
লোথা ভাষা ব্যবহারকারী মানুষেরা মূলত দ্বিভাষিক অথবা ত্রিভাষিক। নাগাল্যান্ডের সরকারি ভাষা নাগামিজ ছাড়াও এই অধিবাসীরা ইংরেজি ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন। এদের মাতৃভাষা লোথার উপর নাগামিজ ভাষার প্রভাব অত্যন্ত বেশি। এই ভাষার প্রকার অর্থাৎ ডায়ালেক্টগুলি মিউচুয়ালি ইন্টেলিজিবল অর্থাৎ পরস্পরবোধ্য। এর ফলে দুটি ভিন্ন প্রকারের মধ্যে অঞ্চলগত প্রভেদ থাকলেও অনেকসময় দুটি ভ্যারিয়ান্টের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটে থাকে। এছাড়া এই ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে কোড-সুইচিং ও কোড-মিক্সিং এর প্রবণতাও রয়েছে। তবে নাগাল্যান্ড রাজ্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে লোথা ভাষায় পঠনপাঠন আরম্ভ হওয়ার ফলে ভাষাটির চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই ভাষার একটি নিজস্ব স্ক্রিপ্ট অর্থাৎ লিপির গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী লোথা সম্প্রদায়ের মানুষ বিদ্যালয়স্তরের শিক্ষায় লোথা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ লাভ করেন না।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India- 2001
BIBLIOGRAPHY: Basu, J. Et al. 2016. Experimental Study of Vowels in Nagamese, Ao and Lotha: Languages of Nagaland. CDAC, Kolkata
Bruhn, D.W. A Phonological Reconstruction of Porto-Central Naga; PhD Thesis, University of California, Berkley
Ezung, M. 2014. Traditional Religion of the Lotha-Nagas and the Impact of Christianity; PhD Thesis, Nagaland University.