নেপালি ভাষা

গ্রিয়ারসন (১৯১৬, খণ্ড-৯, ভাগ-৪) নেপালি ভাষাকে ইষ্টার্ন পাহারি ভাষা বলে ব্যক্ত করেছেন। এই ভাষার আদি নাম ‘খাস-কুরা’ যা পরবর্তীকালে নেপালি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। নেপালি একটি ইন্দো-আরিয়ান ভাষা তবে নেপালি জাতি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নয়, বরং একটি বহুজাতিক এবং বহুভাষিক গোষ্ঠী (P.L.S.I, পৃষ্ঠা-১৪) । মূলত দুই প্রকারের নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ঃ

১। ইন্দো-আর্যরা যারা হিন্দু- বাহন, ছেত্রী, কামী, দামৈ এবং

২। টিবেটো- বার্মান যারা গুরং, মংগর, তামং, রাই, লিম্বু

P.L.S.I, পৃষ্ঠা-১৭ অনুযায়ী ‘দামৈ’ রাই আসল নেপালিভাষী।

নেপালি গোষ্ঠীদের ভারতবর্ষে আগমনের ইতিহাস সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, এরপর যুগে যুগে নেপালিদের ভারতবর্ষে বসবাস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গোষ্ঠীর মানুষ নেপাল ছাড়াও সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিং জেলার চা বাগানে অধিকাংশ নেপালিদের বসবাস, এছাড়াও মূলত উত্তরবঙ্গেই নেপালিদের বসবাস। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও নেপালিরা বসবাস করেন যেমন অসম, মেঘালয় ও সিক্কিম।

দার্জিলিং অঞ্চলে চা বাগানের ব্যবসায়িক বৃদ্ধি হওয়ায় নেপালি জাতির মানুষের আর্থিক উন্নতি হয় এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে নেপালি অধিবাসিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১১ সালের সেনসাস্ রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে বর্তমানে ২,৯২৬,১৬৮ নেপালিভাষীরা বসবাস করেন। গ্রিয়ারসন নেপালি ভাষার সঙ্গে রাজস্থানি আঞ্চলিক ভাষাগুলির সাদৃশ্যের কথা বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে নেপালি সংস্কৃত ও প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে নেপালি ভাষা প্রধানত ‘গোর্খা’ উপজাতির মানুষজন ব্যবহার করে থাকে। এই ভাষার সঙ্গে টিবেটো-বার্মান ভাষাগুলির অনেক মিল পাওয়া যায়। তার প্রধান কারণ হল যেই যেই অঞ্চলে এই ভাষা কথিত হয় সে সব এলাকায় টিবেটো-বার্মান ভাষাগুলি বলার প্রচলন বেশি। ভারতবর্ষের ২২টি প্রধান ভাষার মধ্যে নেপালি একটি ভাষা। ১৯৯২ সালে এই ভাষাকে একটি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতবর্ষে এই ভাষা কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় এই ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তবে সরকারি কাজকর্মে এই ভাষা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় না (P.L.S.I, পৃষ্ঠা-২৩) । কালিম্পং, দার্জিলিং, খোরসাং, মিরিক ইত্যাদি অঞ্চলে নেপালি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।

নেপালি ভাষাতে উচ্চশিক্ষার সুযোগও পশ্চিমবঙ্গে বহুদিন আছে। এই ভাষায় রচিত সাহিত্য সাধারণত দেবনাগরী লিপিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। নেপালি ভাষায় সাহিত্য রচনা আরম্ভ হয় বহু পূর্বে। এই ভাষায় প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা থাকার ফলে দিনে দিনে নেপালিভাষীদের সংখ্যা বেড়ছে। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীরাও এই ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে।

P.L.S.I, পৃষ্ঠা-১৭, ভারতীয় নেপালিদের প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে তাদের নেপালের লোক বলে দূরে সরিয়ে রাখাকে ব্যক্ত করেছে। তাঁদের নিজেদের দেশেই ভিনদেশী হিসেবে গণ্য করা হয় বলে তাঁরা নিজেদের জাতির নামটাই বদলে ফেলে “ভারতীয়- গোর্খালি” বা ভারপালি হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।

P.L.S.I, পৃষ্ঠা-১৯-এ নেপালি ভাষার বিকাশ কে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে হয়েছে- প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। প্রতিটি যুগের কিছু নেপালি সাহিত্য রচনার দলিল পাওয়া গিয়েছে তার থেকে এই ভাষার কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এবং আধুনিক যুগের নেপালি রচনাগুলির মধ্যেও পরিবর্তন দেখা গিয়েছে।

নেপালি ভাষায় মোট ১৩ স্বরবর্ণ ও ৩৮ টি ব্যাঞ্জনবর্ণ আছে যা প্রতিটি সংস্কৃত দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়ে থাকে। এই ভাষায় সংখ্যাগুলিও দেবনাগরীতে লেখা হয়ে থাকে।

নেপালি ভাষায় বাক্যগঠনের ক্রমটি হল কর্তা- কর্ম – ক্রিয়া (S-O-V) অর্থাৎ বাংলা ও হিন্দির মতন। একটি উদাহরণ দেওয়া হলঃ
মাইতে -পাপ -গারেঁ
আমি -পাপ -করেছি এই ভাষাতে পদ প্রকরণ পাঁচ প্রকার; বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় এবং ক্রিয়া। বিশেষ্যর রূপভেদ তিন প্রকার- লিঙ্গ, বচন আর কারক বিভক্তি। ক্রিয়ার রূপভেদ পাঁচ প্রকার; কাল, ভাব, প্রকার, বাচ্য এবং পুরুষ। এই ভাষার ব্যাকরণ বাংলা ও হিন্দির মতন তার কারণ প্রতিটি ভাষাই সংস্কৃত থেকে উদ্ভব হয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী :

Bal, K. B. (2004-2007). Structure of Nepali Grammar. Nepal: Madan Puraraskar Pustakalaya.

Basu, I., Chatterjee, A., Dutta, B., Choudhury, R., Bhowmick, A., Basu, S., . . . Pradhan, G. (2017). Nepali. In G. Devi, S. P. Singha, & I. Bhattacharya (Eds.), People's Linguistic Survey in India, Vol-31,Part-3 (pp. 14-40). Orient Black Swan.

Grierson, G. A. (1916). Linguistic Survey in India, Vol-9,Part-4. Kolkata: Goverment Printing.

Oja, S., Oja, B., Turin, M., & Uphoff, E. (2004). Nepali-English and English-Nepali Glossary. Cornell University.