পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

জেমি সংস্কৃতি

জেমি-নাগা জনজাতির আদি বাসস্থান মণিপুর ও নাগাল্যান্ড রাজ্যে হলেও পরবর্তীকালে এরা জীবিকাসংক্রান্ত অথবা অন্যান্য কারণে অসমের কাছাড় জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত জেলাগুলিতে চলে আসে। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে এরা তফশিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃত। এদের দেহগঠন প্রধানত মোঙ্গলয়েড আকৃতির- খর্বাকৃতি ও চোখ ছোটো। এদের সমাজ পেট্রিয়ার্কাল ও পেট্রিলিনিয়াল। এছাড়া বিবাহের সময় পেট্রিলোকালিটি পালন করা হয়। এদের মধ্যে প্রধানত মনোগ্যামি অর্থাৎ একগামীতা প্রচলিত হলেও খ্রিস্টধর্ম-পূর্ব যুগে এদের মধ্যে বহুগামীতাতাও প্রচলিত ছিলো। এদের নিজস্ব ধর্ম হলো অ্যানিমিজম এর উপর নির্ভরশীল প্রাচীন ধর্ম যেখানে বিভিন্ন টোটেম ও অপদেবতার উপাসনার প্রথাও প্রচলিত ছিলো। এদের এই নিজস্ব ধর্ম ‘পাউপাই-তেনাসে' নামে পরিচিত। এছাড়া এদের এই নিজস্ব ধর্মটি ‘হেরাকা' নামেও পরিচিত। শিকার করা জন্তু-জানোয়ারের মাথা দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার প্রথাও এই জনজাতির মধ্যে প্রচলিত ছিলো। তবে বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের মাধ্যমে শিকারের প্রথাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফলে শিকারের প্রবণতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

বিশিষ্ট রংমেই ঐতিহাসিক গাঙ্গুমেই কাবুই এর মতে, ‘জেলিয়াংরং’ শব্দটি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ প্রথম ব্যবহার করা হয়। তাঁর মতে এই তিনটি জনজাতিকে একত্রীকরণের কারণ হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি। ‘জাদোনাং' এবং ‘গাইদিনলিউ' এই দুটি আন্দোলনের মাধ্যমে তিনটি জনজাতিকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়। তিনি এই তিনটি পৃথক জনজাতিকে একত্রে নির্দেশ করতে ‘হামেই'নামে একটি শব্দ ব্যবহার করেন, যা একটি মিশ্রগোষ্ঠীর ইঙ্গিত দেয়।

এদের সমাজে অবিবাহিত পুরুষ এবং মহিলা- উভয়েরই থাকার জন্য ডর্মিটরি ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। যুবক এবং যুবতীদের জন্য নির্ধারিত ডর্মিটরি যথাক্রমে ‘হাংসেওকি’ এবং ‘লেওসেওকি' নামে পরিচিত। এদের সমাজে এই ডর্মিটরি ব্যবস্থাটি ‘মোরাং' নামে পরিচিত। জেমি সমাজে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় কেউ মারা গেলে তাকে স্মরণ করে একটি কূপ খননের প্রথা রয়েছে- এই বিশেষ কূপটি ‘ডেকুয়াকুইবে'নামে পরিচিত। এদের সমাজ গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রাম প্রতিষ্ঠার সময় মাটিতে একটি বড়ো পাথর পুঁতে দেওয়ার প্রথা রয়েছে, যে পাথরটি ‘হেজুয়াদেকুং' নামে পরিচিত। এই পাথরটি যেখানে স্থাপন করা হয়, সেখানে গ্রামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি পালন করা হয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে তাঁর পরিবারও এরকম পাথর স্থাপন করতে পারে, যেটি ‘হেকুয়াকুয়াবে' নামে পরিচিত। অন্যান্য নাগা জনজাতির মতো জেমি সমাজেও কোনো মানুষের মৃত্যুর পর তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

এদের বেশ কিছু নিজস্ব উৎসব পালনের প্রথাও রয়েছে। এই উৎসবগুলি প্রধানত ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে পালন করা হয়। এই উৎসবগুলির মূল উপলক্ষ্য হলো জেমি জনজাতির প্রধান দেবতা ‘তিঙওয়াং’ এর আশীর্বাদ লাভ করা। এদের পালিত কয়েকটি প্রধান উৎসব হলো ‘মাতুইবে', ‘হেলেই', ‘হেলেইবাম' ইত্যাদি। এদের মধ্যে লোকসংগীত ও লোকনৃত্যেরও প্রচলন রয়েছে। এদের নিজস্ব নৃত্যশৈলী ‘হেলিম' নামে পরিচিত। এর বিশেষ কতকগুলি প্রকার রয়েছে, যেমন- যুদ্ধের নাচ ‘হেরেলিম’, ‘হেরেপিয়েবেলিম' (হর্নবিল নাচ) ইত্যাদি। এছাড়া এদের নিজস্ব লোককথা এবং উপকথারও নিদর্শন রয়েছে, যেগুলি এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এই লোককথা অর্থাৎ ফোকটেলগুলি ‘হেরাসাম' নামে পরিচিত। এদের নিজস্ব লোকগানের ঐতিহ্যও বর্তমান। এই নিজস্ব গানগুলি ‘হেলেউ' নামে পরিচিত। এদের নিজস্ব পোশাক এবং গয়না পরার প্রথা রয়েছে। এই পোশাক মূলত এই এই জনজাতির মহিলারা সুতো দিয়ে তৈরি করেন। পুরুষ এবং মহিলাদের পরিহিত গয়নাগুলি যথাক্রমে ‘তেবাতেউ’ ও ‘তেলুইতেউ' নামে পরিচিত। এগুলি মূলত শঙ্খ দিয়ে নির্মিত হয়। এদের নিজস্ব কিছু বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে, উৎসবের সময় গান ও নাচের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য এগুলি ব্যবহৃত হয়। এরকম কতকগুলি বাদ্যযন্ত্র হলো ‘নসুম' (ড্রাম), ‘নটুক' (মাউথ অর্গান), ‘মেতিয়াম’ (বাঁশি) ইত্যাদি।

তবে বর্তমানে জেমি-নাগা জনজাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে এদের প্রাচীন অ্যানিমিস্ট ধর্ম এবং তার সঙ্গে জড়িত ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং প্রথাগুলির প্রচলন ক্রমশ কমছে। তবে খাদ্য, পোশাক, লোকসংগীত ইত্যাদি বিষয়গুলি এদের মধ্যে এখনও প্রচলিত রয়েছে। তবে আধুনিকতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারের ফলে মহিলাদের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তবে এখনও জেমি-নাগা সমাজে সম্পত্তির উপর মহিলাদের কোনো উত্তরাধিকার স্বীকৃত নয়।

পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে এই জনজাতি অন্যন্য পার্বত্য জনজাতির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় বসবাসের ফলে একটি মিশ্র সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে। এই জনজাতি মূলত দ্বিভাষিক ও ত্রিভাষিক। সরকারি সুযোগ এবং লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এরা মূলত ইংরেজি ভাষাকে বর্তমানে মাধ্যম হিসেবে বেশি ব্যবহার করে। এদের নিজস্ব ভাষার কোনো লিপি না গড়ে ওঠার ফলে এদের ইতিহাস মূলত মৌখিক ইতিহাস হিসেবেই রয়ে গেছে। অন্য ভাষা এবং সংস্কৃতির মিশ্র প্রভাবে জেমি-নাগা জনজাতির নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির অবনমন ঘটছে। এর পিছনে বেশ কিছু ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চর্চার অভাব এবং গবেষণামূলক কাজের অভাব এই অবনমনের অন্যতম প্রধান কারণ।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India- 2011

Chanu, S.S. 2016 Numerals in Zeme; Language in India

Mishra, Dr. R. & Newme, K. 2015. Social Communication and Traditional Folk Media of the Semi Naga Society; Global Media Journal- Indian Edition

Zeme, Naga; www.ethnologue.com