গাংতে ভাষা

গাংতে ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত কুকিচীন শাখার উত্তর উপশাখার একটি ভাষা, যা মূলত মণিপুর, মেঘালয় এবং অসম রাজ্যের কিছু অংশে প্রচলিত হলেও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় বসবাসকারী অল্পসংখ্যক গাংতে জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। এই ভাষা প্রকৃতিগতভাবে সমসত্ত্ব প্রকৃতির, অর্থাৎ এতে কোনো উপভাষা তথা প্রকারগত বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় না। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত থাডৌ, সিমতে, ভাইপেই, কোম, পাইতে ইত্যাদি ভাষার সঙ্গে গাংতে ভাষা আংশিক পারস্পরিক বোধগম্যতার সূত্রে আবদ্ধ। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জনজাতির মানুষের মোট সংখ্যা ১৭৫৪২ জন।

ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে গাংতে ভাষা অন্যান্য কুকিচীন গোত্রের ভাষাকেই অনুসরণ করে। এই ভাষায় বিশেষ্যের সঙ্গে বচন ও লিঙ্গের মার্কার যুক্ত হয়। এছাড়া কেস-মার্কার এবং পোস্ট-পোজিশনও বসতে পারে। বিশেষণ, নিউমেরাল অর্থাৎ সংখ্যাবাচক শব্দ, কোয়ান্টিফায়ার ইত্যাদি বিশেষ্যের পরে বসে। এই ভাষার বিশেষ্য পদগুলি মনোমর্ফেমিক বা মাল্টিমর্ফেমিক হয়। বিশেষ্য পদ দুই শ্রেণির হয়- ডিরাইভড ও নন-ডিরাইভড। যেগুলি নন-ডিরাইভড বিশেষ্য, সেগুলি প্রকৃতিগতভাবে সরল এবং ডিরাইভড বিশেষ্যগুলি প্রকৃতিগতভাবে জটিল প্রকৃতির হয়। এই বিশেষ্যগুলির বেশিরভাগ ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়া এবং অ্যাডজেক্টিভ অর্থাৎ বিশেষণকে নমিনালাইজ করার মাধ্যমে গঠন করা হয়। প্রোনাউন অর্থাৎ সর্বনাম গাংতে ভাষায় বিশেষ্যের পরিবর্ত হিসেবে এবং টপিক ও অ্যাট্রিবিউট রূপে ব্যবহৃত হয়। সর্বনাম দুইভাবে বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত হতে পারে- মুক্ত অর্থাৎ ফ্রি ফর্ম এবং ক্লিটিক ফর্ম। ফ্রি অর্থাৎ মুক্ত অর্থে ব্যবহৃত সর্বনামটি নিজেকেই সূচিত করে; অপরপক্ষে, ক্লিটিক ফর্মে ব্যবহৃত সর্বনামটি ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট ক্লিটিক মার্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ক্লিটিক ফর্মের সর্বনামগুলি বিশেষ্যের পূর্বে বসে পোজেশন অর্থাৎ অধিকারও বোঝায়। পোজেসিভ প্রোনাউন অর্থাৎ অধিকারসূচক সর্বনামের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বনামটি অধিকৃত বস্তুর পূর্বে বসে। কুকিচীন গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষার মতোই গাংতে ভাষাতেও জেন্ডার অর্থাৎ লিঙ্গ অর্থের ভিত্তিতে সূচিত হয়। মরফো-সেমান্টিক ভিত্তিতে এই ভাষার বিশেষ্যগুলি জীব ও জড়- এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। জীব শ্রেণির মধ্যে পুংলিঙ্গের সূচক হিসেবে ‘–পা’ মার্কার ব্যবহার করা হয় এবং স্ত্রীলিঙ্গ সূচক হিসেবে ‘–নু’ মার্কার ব্যবহার করা হয়। যেমন- ‘বড়োভাই’ এই শব্দটি ভাইপেই, থাডৌ এবং গাংতে- এই তিনটি ভাষাতেই ‘উপা’, এবং ‘বড়োদিদি’ অর্থে ‘উনু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তবে জীবশ্রেণির বিশেষ কিছু বিশেষ্য এই ‘–পা’ মার্কার নেয় না। জড় শ্রেণির বিশেষ্যের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গের মার্কার হিসেবে গাংতে, ভাইপেই ও থাডৌ ভাষাতে –চা মার্কার, এবং স্ত্রীলিঙ্গসূচক মার্কার হিসেবে ‘–পি’ ব্যবহার করা হয়। সর্বনামের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র প্রথম পুরুষের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত প্রভেদ স্বীকার করা হয়। গাংতে ভাষায় গ্লটাল স্টপের পরে যখন অপর একটি সিলেবল থাকে, তখন এই গ্লটাল স্টপটি অন্তর্হিত হয়। এই ভাষায় নাম্বার অর্থাৎ বচন তিন প্রকার- একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। একবচনের ক্ষেত্রে কোনো মার্কার ব্যবহার করা হয় না; দ্বিবচনের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বা সর্বনামের পর সাফিক্স হিসেবে ‘দুই’ এই নিউমেরিকাল অর্থাৎ সংখ্যাবাচক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বহুবচনের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বা সর্বনামের পর ‘–তে’ মার্কার ব্যবহার করা হয়। কেস অর্থাৎ কারক সম্পর্কগুলি এই ভাষাতে বিশেষ্যের পর শেষ অংশে পোস্টপোজিশন হিসেবে আসে। গাংতে ভাষায় কেস প্রধানত এর্গেটিভ- অ্যাবসোলিউটিভ, জেনিটিভ, ডেটিভ ও বেনিফ্যাক্টিভ ও কমিটেটিভ হয়। এই ভাষাতে সাবজেক্ট-ভার্ব এগ্রিমেণ্ট দেখা যায়, অর্থাৎ, উত্তম, মধ্যম ও প্রথম এই তিন পুরুষেই কর্তার সঙ্গে ক্রিয়ার এগ্রিমেন্ট দেখতে পাওয়া যায়। এই ভাষায় বিশেষ্যের ক্লাসিফায়েরেরও প্রয়োগ রয়েছে। এছাড়া রিডুপ্লিকেশন, যৌগিক বিশেষ্য গঠন, ফ্ল্যাট আইটেম, ইলংগেটেড আইটেম ইত্যাদি ভাষার রূপগত বৈশিষ্ট্যগুলি অন্যান্য কুকিচীন ভাষার মতো গাংতে ভাষাতেও উপস্থিত। মণিপুরি, মিজো এবং হামার ভাষার মতো এই ভাষাতেও দূরত্বের সূচক হিসেবে ‘স্প্লিট-ডিটারমিনার’ ব্যবহার করা হয়। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যার জন্য গাংতে ভাষায় মনোমর্ফেমিক শব্দ ব্যবহৃত হয়; ১০ এর পর থেকে যৌগিক শব্দগঠন আরম্ভ হয়।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India- 2011

Haokip, Pauthang. 2009. Noun Morphology in Kuki-Chin languages; Language in India

Singh, C.Y. 1995. The Linguistic Situation in Manipur. Linguistics of the Tibeto-Burman Area