কোল জনজাতির মানুষ রামায়ণে উল্লিখিত ‘শবর মাতা’ চরিত্রটিকে তাদের আদি মাতা বলে মনে করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোল জনজাতি পরিযানের মাধ্যমে সমগ্র মধ্য ও পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এদের আদি বাসস্থান মধ্যভারতের জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায় হলেও বর্তমানে ছোটনাগপুর মালভূমি, যা বৃহত্তর দাক্ষিণাত্যের মালভূমির অংশ, এদের বাসস্থান হিসেবে স্বীকৃত। মালভূমি অংশের অনুর্বর মাটিতে কৃষিকাজ ভালো না হওয়ায় এরা জঙ্গলকেন্দ্রিক নোম্যাডিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং শিকারই এদের প্রধান জীবিকা। তবে ব্রিটিশ শাসনকালে অন্যান্য আদিবাসী জনজাতির মতো এদের কাছ থেকেও জঙ্গলের উপর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
কোল জনজাতি কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত; যেমন- রাউটিয়া, রাউটেল, দাসাও, দাহাইত, বিরাটিয়া, ঠাকুরিয়া প্রভৃতি মোট ২২টি গোত্র কোল সমাজে রয়েছে, যেগুলি ‘বাইনিক’ নামে পরিচিত। এই গোত্রগুলির ভিতর উচ্চ-নীচ শ্রেণিবিভাগ থাকার ফলে এদের মধ্যে আন্তর্গোত্রীয় বিবাহ স্বীকৃত নয়। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ক্রুক কোল জনজাতির মধ্যে ৯টি ‘সেপ্ট’ এর উল্লেখ করলেও বর্তমানে কেবলমাত্র ৭টির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কোল সমাজ প্রধানত মনোগ্যামাস অর্থাৎ একগামী হলেও বহুগামীতা অর্থাৎ পলিগ্যামির উদাহরণও পাওয়া যায়। কোল জনজাতির মধ্যে নারী-পুরুষের অনুপাতের হিসেবে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। কোল সমাজে কোনো পুরুষ বিবাহ না করেও কোনো নারীকে ‘রাখেলু’ হিসেবে রাখতে পারে, যা মর্যাদার কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোল সমাজে ‘ক্রস কাজিন’ ও ‘প্যারালাল কাজিন’ অর্থাৎ তুতো ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহ স্বীকৃত নয়। বিবাহের সময় কন্যাপণ দেওয়ার প্রথা কোল সমাজে প্রচলিত রয়েছে, যা ‘চারি’ নামে পরিচিত। কোল সমাজ ‘পেট্রিলোকাল’ অর্থাৎ বিবাহের পর সাধারণত কন্যা বরের বাড়িতে অবস্থান করে। পরিবারের সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর কেবলমাত্র পুরুষদেরই উত্তরাধিকার স্বীকৃত।
কোল সমাজের প্রধান ‘মালিক’ নামে পরিচিত। তিনজন সদস্য (মুখোবার) সম্বলিত একটি সংসদের মাধ্যমে মালিক সামাজিক রীতিনীতি ও অনুশাসনগুলির পালনের উপর নজর রাখেন। কোল সমাজে এই ‘মালিক’ পদটি সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়। দুটি পৃথক গ্রামের মধ্যে বিবাদের ক্ষেত্রে পাঁচজন সদস্য নিয়ে গঠিত ‘নয়াপঞ্চ’ নামে একটি বৃহত্তর সংগঠন বিবাদের মীমাংসা করে থাকে।
পূর্বে কোল জনজাতির মধ্যে অ্যানিমিজম ও টোটেম উপাসনার প্রথা থাকলেও ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের পরের জনগণনাগুলি কোল জনজাতির মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রাধান্যের ইঙ্গিত দেয়। এদের সমাজের নিজস্ব প্রধান পুরোহিত ‘পাণ্ডা’ নামে পরিচিত। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি পালন করা ছাড়াও ‘ওঝা’ অর্থাৎ চিকিৎসক হিসেবেও এই পুরোহিতের ভূমিকা রয়েছে। কোল সমাজের নিজস্ব দেবতাদের মধ্যে ‘বাবাদেও’ এবং ‘মারহী’ হলেন পারিবারিক দেবতা, ‘খেরদাই’, ‘হরদোলা’ ইত্যাদি হলেন গ্রামদেবতা। তবে বর্তমানে হিন্দুধর্মের প্রাধান্যের কারণে লৌকিক হিন্দু দেবদেবীর পূজাও কোল সমাজে প্রচলিত। এদের ইতিহাস মূলত মৌখিক, যার কোনো লিখিত প্রমাণের অস্তিত্ব নেই। এদের নিজস্ব লোককথা ও উপকথাগুলিও লিপিবদ্ধ করা হয়নি। হিন্দু ধর্মের অনুসরণে এরা মানুষের মৃত্যুর পর মৃতদেহ সৎকার করে তেরো দিন পর তার পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করে।
কোল জনজাতির ভাষাটি বর্তমানে প্রবীণ প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ, উত্তর প্রজন্মের মধ্যে এই ভাষাটির যথাযথ সঞ্চারণ ঘটেনি। কোল ভাষাটি বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিল অনুযায়ী স্বীকৃত সরকারি অথবা আঞ্চলিক ভাষা নয়। ফলে এই ভাষাতে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নেই। এই জনজাতির নবীন প্রজন্মের মধ্যে একটি সহজাত দ্বিভাষিক প্রবণতা রয়েছে। মুন্ডারি ও ভূমিজ ভাষা অনেকক্ষেত্রে এদের মধ্যে প্রথম ভাষার স্থান নিয়েছে এবং এই দুটি ভাষা এবং হিন্দিভাষা থেকে ক্রমাগত বেশ কিছু শব্দ কোল ভাষার শব্দভাণ্ডারে অনুপ্রবেশ করছে। কোল ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত ও প্রামাণ্য গবেষণামূলক কাজের অভাব রয়েছে।
Census of India- 2011
Kol; Communities and their Cultures
Kol; www.ethnologue.com
Srivastava, A. et al. Genetic and Linguistic non-correspondence suggests evidence for collective social climbing in the Kol tribe of South Asia; www.nature.com