ডিমাসা ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের ব্রহ্মপুত্র শাখার বোড়ো-গারো উপশাখার একটি ভাষা, যা মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম ও নাগাল্যাণ্ড রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের তরাই-ডুয়ার্স পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত আলিপুরদুয়ার,জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী ডিমাসা জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। মূলত অসমের ডিমা-হাসাও, কাছাড়, কার্বি-আংলং ও নওগাঁ জেলায় এই জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে ডিমাসা ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ১৩৭১৮৪ জন। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই; লেখার কাজে ল্যাটিন, বাংলা ও অসয়া লিপি ব্যবহার করা হয়। বোড়ো, গারো এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম প্রধান ভাষা ককবরকের সঙ্গে ডিমাসা ভাষার সাদৃশ্য রয়েছেপ্রায় ৮০০ শেরপা জনজাতির মানুষের বসবাস রয়েছে। শেরপা মূলত একটি মৌখিক ভাষা, লেখার সময় দেবনাগরী এবং তিব্বতি লিপি ব্যবহার করা হয়।

ডিমাসা শব্দের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই শব্দের অর্থ হলো ‘বড়ো নদীর পুত্র’। এই বড়ো নদী বলতে অসমে ব্রহ্মপুত্রকে বোঝায়। ‘ডিমা’ শব্দের অর্থ হলো নদী এবং ‘সা’ শব্দের অর্থ হলো পুত্র। ডিমাসা হলো উত্তর-পুর্ব ভারতে প্রচলিত সেই বিরল ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম, যেটি বিদেশী ভাষার প্রভাব সম্পূর্ণ বর্জন করে নিজস্ব শব্দভাণ্ডারকে সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। ডিমাসা ভাষায় ৬টি স্বরধ্বনি রয়েছে যেগুলি শব্দের আদি, মধ্য এবং অন্ত- এই তিনটি জায়গাতেই বসতে পারে। এছাড়া এই ভাষায় ১৬টি ব্যঞ্জনধ্বনি এবং আটটি ডিপথং রয়েছে। এদের মধ্যে ন্যাসাল (ভয়েসলেস ও ভয়েসড), স্টপ অর্থাৎ প্লোসিভ (অ্যাস্পিরেটেড ও ভয়েসড), ফ্রিকেটিভ, ফ্ল্যাপ/ট্রিল এবং অ্যাপ্রক্সিমেন্ট ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। তিনটি ভয়েসলেস-অ্যাস্পিরেটেড স্টপ যথা- /ফ/, /ঠ/ও /খ/ সিলেবল-ফাইনাল পজিশনে আনরিলিজড অবস্থায় থাকে। আনঅ্যাস্পিরেটেড-ভয়েসড স্টপগুলি শব্দের শেষে বসতে পারে না। /ফ/, /ব/, /ঠ/, /খ/, /ম/, /ন/ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি শব্দের আদি, মধ্য এবং অন্ত- তিনটি জায়গাতেই বসতে পারে। ডিমাসা একটি ‘ইনফ্লেকশনাল’ ভাষা’; এখানে বাক্যের ক্রিয়াটি কাল, কারক, বাচ্য, প্রকার অর্থাৎ অ্যাসপেক্ট ও মুডের বিভিন্নতার নিরিখে ইনফ্লেক্টেড হয়,কিন্তু লিঙ্গ ও পুরুষের ভিত্তিতে এই ইনফ্লেকশন দেখা যায় না। ডিমাসা ভাষায় সর্বনাম হিসেবে উত্তম পুরুষ একবচনে ‘আং’, উত্তম পুরুষ বহুবচনে ‘জিং’, মধ্যম পুরুষ একবচন ও বহুবচনে যথাক্রমে ‘নিং’ ও ‘নিশি’, এবং প্রথম পুরুষ একবচন ও বহুবচনে যথাক্রমে ‘বো’ এবং ‘বুনশি’ শব্দের ব্যবহার করা হয়। বাক্যতত্ত্বের দিক থেকে দেখলে ডিমাসা একটি SOV ভাষা; অর্থাৎ এখানে বাক্যের ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে কর্তা ও কর্মের পরে বসে। ডিমা-হাসাও জেলায় এই ভাষা লেখার জন্য নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ল্যাটিন লিপির ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অসমের কাছাড় জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হওয়ার কারণে এবং পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্সের সংলগ্ন এলাকায় ডিমাসা ভাষা লেখার কাজে বাংলা লিপি ব্যবহৃত হয়। ডিমাসা ভাষায় হাই এবং লো- এই দুটি টোনের অস্তিত্ব রয়েছে। বিশেষ্যখণ্ডের ক্ষেত্রে ডিটারমিনিটিভ অংশটি হেড-এর পূর্বে বসে, অর্থাৎ এটি একটি হেড-ফাইনাল ভাষা। বেশিরভাগ ক্রিয়ার রূপমূল মনোসিলেবিক হয়। কম্পাউণ্ড ভার্ব অর্থাৎ যৌগিক ক্রিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে দুটি ক্রিয়ার রূপমূলের অস্তিত্ব থাকে। ক্রিয়ার মূলগত রূপটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রূপমূলটির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত হলেও ক্রিয়ার সঙ্গে সাফিক্সের ব্যবহারও আছে, যেগুলি মূলত ক্রিয়ার রূপমূলের পরে বসে। লেক্সিকালাইজেশন ও গ্রামাটিকালাইজেশনের প্রবণতার ভিত্তিতে এদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এই ভাষার ক্লাসিফায়ারগুলি মূলত বাউণ্ড মরফিম হয়। যেকোনো একটি সংখ্যাবাচক শব্দের আগে প্রিফিক্স হিসেবে এই ক্লাসিফায়ারগুলি ব্যবহার করা হয়। এই সংখ্যাবাচক শব্দগুলি নিজেরাই একএকটি বাউণ্ড মরফিম। ডিমাসা ভাষায় ক্লাসিফায়ারের সংখ্যা সীমিত হওয়ার ফলে সমগোত্রীয় একাধিক বিশেষ্যের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ক্লাসিফায়ারের ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। এই ভাষার "দ্বিজুওয়া” নামে একটি ভ্যারাইটি রয়েছে যার ভাওয়েল-চার্টটি নীচে দেওয়া হলোঃ

স্বরধ্বনি - দ্বিজুওয়া

গ্রন্থপঞ্জী :