পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

কালিম্পং জেলা

কালিম্পং জেলা দার্জিলিং থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২১তম জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই জেলা দার্জিলিং হিমালয়ের অংশবিশেষ। কালিম্পং পৌরসভা এবং কালিম্পং-১, কালিম্পং-২ ও গোরুবাথান নামে তিনটি ব্লক নবগঠিত কালিম্পং জেলার অন্তর্গত। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে কালিম্পং এর আয়তন ১০৫৩ বর্গকিমি এবং মোট জনসংখ্যা ২৫১৬৪২ জন। তিস্তা নদী কালিম্পং জেলা ও পার্শ্ববর্তী সিকিম রাজ্যকে পৃথক করেছে।এই জেলার প্রাচীন অধিবাসী লেপচা সম্প্রদায়; এছাড়া ভুটিয়া ও লিম্বু জনজাতি পরিযানের মাধ্যমে কালিম্পং জেলায় বসতি স্থাপন করে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনের তিব্বত আক্রমণের পর তিব্বতিরা তিব্বত পরিত্যাগ করে দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় চলে আসেন, এখানে মনাস্টারি গঠিত হয় এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে।
কালিম্পং জেলার সরকারি ভাষা বাংলা ও নেপালি; তবে লেপচা, লিম্বু ও তিব্বতি ভাষা এখানকার জনজাতিগুলি ব্যবহার করে থাকে। এই ভাষাগুলির প্রত্যেকটিই টিবেটান- তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। লিম্বু একটি টোনাল অর্থাৎ ধ্বনিপ্রধান ভাষা হলেও লেপচা ধ্বনিপ্রধান ভাষা নয়। উভয় ভাষার (লেপচা ও লিম্বু) নিজস্ব লিপি বর্তমান। লিপির উদ্ভবের আগে লেপচা ভাষায় তিব্বতি লিপির ব্যবহার করা হত। লিম্বু ভাষার নিজস্ব লিপি ‘কিরাত সিরজাঙা’ নামে পরিচিত। বর্তমানে লেপচা পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও লিম্বু ভাষাটি পাশের রাজ্য সিকিমে সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে এবং সেখানে লিম্বু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। লিম্বু ভাষার ৪টি প্রকার বর্তমান- পান্থেরে, ফেড়াপে, তামারখোলে এবং ছাত্তারে। এই ভাষায় ৯টি স্বরবর্ণ ও ২৫টি ব্যাঞ্জনবর্ণ বর্তমান।
কালিম্পং জেলায় বাঙালি, নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা, লিম্বু ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বসবাসের মাধ্যমে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটেছে। কালিম্পং শহরের কাছাকাছি লেপচা মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে যা এই জনজাতির উপাসনা পদ্ধতি, বাদ্যযন্ত্র, পাণ্ডুলিপি ও হাতে বোনা জিনিসপত্রের সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। লেপচা ভাষার মৌখিক ও লৌকিক গাথার সম্বৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এই জনজাতি মূলত পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষে অভ্যস্ত হলেও বর্তমানে এরা প্রচলিত প্রথায় জমি কর্ষণ ও জৈবসার প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিকাজ করে থাকে। এরা কৃষিজ ফসল বাজারে বিক্রি করে না, নিজেরা আহার্য হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে এই জনজাতির শিশুরা সরকারি ভাষা নেপালি ও ইংরেজি মাধ্যমে মিশনারি স্কুলে শিক্ষালাভ করার ফলে লেপচা ভাষা শেখার ও ব্যবহার করার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। কালিম্পঙে লেপচা জনজাতি ও ভাষার উন্নয়নের জন্য লেপচা উন্নয়ন পরিষদ গঠিত হয়েছে।
লিম্বু জনজাতিও বহিরাগত নেপালি, ভুটিয়া ও তিব্বতিদের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশের ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। লিম্বু জনজাতির প্রধান উৎসব ‘চাসোক তাংনাম’, ঐতিহ্যশালী পোশাক ‘মেখলি’ ইত্যাদির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাবে এই জনজাতিগুলির নিজস্ব ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অবনমন ঘটেছে।