ইয়াক্কা জনজাতির আদি বাসস্থান হলো পূর্ব নেপালের অরুণ নদী উপত্যকা। ইয়াক্কা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে ব্যাকরণবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সংস্কৃত নৈয়ায়িকদের মতে মূল শব্দটি হলো ‘যক্ষ’। ইয়াক্কা-নেপালি-ইংরেজি অভিধান অনুসারে ‘ইয়াক্কা’ শব্দের সঙ্গে ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘অক্ম’ শব্দের সংযোগ রয়েছে, যার অর্থ ‘রাতের মতো থেকে যাওয়া’। এই শব্দটির মৌখিক অবনমনের মাধ্যমে ‘ইয়াক্কা’ শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। বর্তমানে নেপালের কাঠমান্ডু উপত্যকাকে ইয়াক্কাদের বাসভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইয়াক্কা জনজাতি কিরাতি ধর্ম ও উপাসনা পদ্ধতি অনুসরণ করে। এদের সমাজে ৩২টি ‘ঠার’ অর্থাৎ পারিবারিক উপাধি রয়েছে। প্রত্যেকটি ঠার কতকগুলি উপবিভাগ তথা ‘সামচোং’ এ বিভক্ত। একই সামচোং এর অন্তর্গত পরিবারগুলির মধ্যে বিবাহ হয় না। দেহগাঠনিক দিক থেকে এরা মোঙ্গলয়েড আকৃতির, চোখ ছোট, বর্ণ বাদামি ও উচ্চতা মাঝারি। এই জনজাতির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকারী লিম্বু জনজাতির কোনো সাদৃশ্য নেই।
এদের বাড়িগুলি প্রধানত পাহাড়ের ঢালে পাথরের সাহায্যে তৈরি হয়। এছাড়া গাছের গুঁড়িও ব্যবহৃত হয়। বাড়ির সামনের দিকে ফাঁকা জায়গা রাখার চল রয়েছে। বাড়ির মূল ঘরের পূর্বকোণে অন্যান্য রাই জনজাতির মতোই ‘সামখালুং’ নামে প্রধান দেবতার অধিষ্ঠান থাকে। এই দেবতার কোনো মূর্তি নেই, তিনটি পাথরের সাহায্যে একটি কাঠামো গঠন করা হয়, যা ঐ দেবতার চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কারো ঐ দেবাতাকে ছোঁয়া বা উপাসনা করার অধিকার থাকে না। বাড়ির বিবাহিত কন্যাদেরও ঐ স্থানে প্রবেশাধিকার থাকে না। মনে করা হয় ঐ দেবকাঠামোর মধ্যে পূর্বপুরুষের আত্মা বসবাস করেন। ঐ তিনটি পাথরের মধ্যে একটি পুরুষ পূর্বপুরুষ, একটি নারী পূর্বপুরুষ এবং তৃতীয়টি সমাজকে বোঝায়। ঠিক একইরকম তিনটি পাথর দিয়ে তৈরি অপর একটি কাঠামো রোজকার রান্নার কাজে এই জনজাতি ব্যবহার করে। এদের জীবিকা মূলত শিকার ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ। এদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালনের সময় তীর ধনুকের অত্যাবশ্যকীয় উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। মুরগি ও শুকরের মাংস, ডিম, মাছ, সবজি, উদ্ভিদের খাদ্যযোগ্য মূল ইত্যাদি এদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত। গম ও বার্লি থেকে তৈরি একপ্রকার দেশি মদ পুরুষ ও নারী উভয়েই পান করে থাকে।
ধান , ভুট্টা ও বাজরার মরশুমি চাষ এদের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। এছাড়া অর্থকরী ফসল হিসেবে জমির আলে আদার চাষও এরা করে থাকে। খাদ্যযোগ্য মাশরুম এরা নিকটবর্তী বন থেকে সংগ্রহ করে। এছাড়া নদী ও ঝরণার জলে মাছ ধরা, ফল ও সরষের চাষ ইত্যাদি এদের আয়ের উৎস। শিকারের কাজে এরা তীর ধনুক ছাড়াও জাল ও ফাঁদ ব্যবহার করে। এদের ব্যবহৃত তীরের ফলায় অনেকসময় বিষ মাখানো থাকে, যার ফলে পশু শিকার সহজসাধ্য হয়।
এরা মূলত প্রকৃতির উপাসনা করে। মূর্তিপূজার প্রচলন নেই, তার পরিবর্তে এরা টোটেম উপাসনায় বিশ্বাসী। এদের সমাজে পরুষ ও নারী উভয়েই পুরোহিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে; পুরুষ পুরোহিত ‘মাংপা’ ও নারী পুরোহিত ‘মাংমা’ নামে পরিচিত। ইয়াক্কা সমাজে নদী, পাহাড়, গাছ ইত্যাদি প্রত্যেক প্রাকৃতিক বস্তুরই আত্মা আছে বলে মনে করা হয়। তারা মনে করে এই আত্মাসমূহ কোনো পবিত্র স্থানে বসবাস করে। এছাড়া এদের মধ্যে পূর্বপুরুষের উপাসনার রীতিও প্রচলিত। বর্তমানে ইয়াক্কা জনজাতির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তারা মৃত্যুর পর স্বর্গ বা মর্ত্যে যাবার ধারণায় বিশ্বাসী নয়। ইয়াক্কাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দুটি স্থানের কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ‘মাংপা’ অর্থাৎ পুরোহিত তার শ্রাদ্ধের দিন ঠিক করেন। এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ‘চিন্তা’ নামে পরিচিত, যা মৃত ব্যক্তির বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই পুরোহিত মৃত ব্যক্তির আত্মাকে পূর্বপুরুষের বসবাসের স্থানে ফিরে যেতে সহায়তা করেন। ইয়াক্কা সমাজে ‘মাংপা’ অর্থাৎ পুরোহিতের অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয়।
এদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও বর্তমান। সমগ্র সমাজ ২৮টি ‘ঠার’ এ বিভক্ত। এই ঠারগুলির মধ্যে আবার গোত্রগত বিভাগ রয়েছে। গোত্রগুলি ‘পাচা’ নামে পরিচিত। গোত্র অর্থাৎ পাচা- এর মধ্যেও উপবিভাগ রয়েছে যেগুলি ‘সামেত’ নামে পরিচিত। এই ‘সামেত’ এর মাধ্যমেই এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তার পূর্বপুরুষের সম্বন্ধ স্থাপন করা হয়। পৃথক গোত্রের পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিবাহই অনুমোদিত হয়। বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্গোত্রীয় বিবাহ হলেও বিবাহিত নারীকে বাড়ির মধ্যে অবস্থিত পবিত্র স্থানটিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। সম্বন্ধ করে বিবাহের ক্ষেত্রে একটি ধাতব পাত্রকে সাক্ষী রাখা হয়। এই প্রথাকে ‘বুলুখুম’ বলা হয়। ‘বুলুখুম’ হলো রুপো বা ব্রাশ মেটালের তৈরি একটি ধাতব পাত্র যা কন্যার বাড়ির তরফ থেকে পাত্রের বাড়িতে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। জোরপূর্বক বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাকে নিয়ে চলে আসার পর তার বাড়িতে পাত্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবে সম্মত হলে বিবাহের আয়োজন করা হয়, যাকে ‘সাপতেন সাংমা’ বলা হয়। বিবাহের পর কন্যাকে পাত্রের বাড়িতে অবস্থান করতে হয়। সামাজিক অনুমোদন সাপেক্ষে বিচ্ছেদের ব্যবস্থাও ইয়াক্কা সমাজে রয়েছে।
ইয়াক্কা জনজাতির মহিলাদের পোশাক ‘ফারিয়া’, ‘লোকলাক’, ‘চোলি’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। ‘নাথেন’, ‘নাবিট’ ইত্যাদি গয়না মহিলারা ব্যবহার করে। ‘পারুওয়া’ নামে একপ্রকার রুপোর গয়নারও প্রচলন রয়েছে। উৎসব অনুষ্ঠানের সময় পুরুষরা ‘সায়ামসাং’ অর্থাৎ পাগড়ি ব্যবহার করে। কাঠ ও বাঁশের তৈরি বাদ্যযন্ত্র অনুষ্ঠানের সময় বাজানো হয়। বাঁশ দিয়ে ‘বিম্বিলা চুম্বক’, ‘মারচুঙ্গা’, ‘ঢোল ঝামটা’ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি নির্মিত হয়। এদের নিজস্ব নৃত্যশৈলী রয়েছে যা ‘সিলি’ নামে পরিচিত। ফসল বোনা ও কাটার সময় পালিত উৎসবগুলিতে নৃত্যের প্রথা রয়েছে।
তবে আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে ইয়াক্কা জনজাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও ভাষিক বৈশিষ্ট্য ক্রমশ বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়েছে। নেপালি ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমবর্ধ্মান প্রভাবে এই জনজাতির নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী প্রথাগুলি নতুন প্রজন্ম ক্রমশ ভুলে যাচ্ছে। ইয়াক্কা ভাষার কোনো সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় এবং পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় বাড়ির সাধারণ কথাবার্তায় এই ভাষার প্রয়োগ ক্রমশ কমছে। ইউনেস্কো এই ভাষাকে ‘ডেফিনিটলি এন্ডেঞ্জারড’ তালিকাভুক্ত করেছে।
Bain, W.K. 2018 An Anthropological Venture into the Rai Community of Darjeeling Hills, West Bengal, India. Research gate
Census of India, 2011
Russell, Andrew. 1992 The Yakha: Culture, Environment and Development in East Nepal. Wolfson College, University of Oxford
Subba, T.B. 1999 Politics of Culture: A Study of Three Kirata Communities in the Eastern Himalayas. Orient Longman