কোচ ভাষা
কোচ ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের বোড়ো-কোচ উপশাখার একটি ভাষা, যা মূলত পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও নেপালে বসবাসকারী কোচ জনজাতির মানুষের মুখের ভাষা। এটি বার্লিং কথিত SAL গ্রুপের ভাষা। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে ৩৬৪৩৪ জন মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। প্রধানত অসম রাজ্যের গোয়ালপাড়া, নওগাঁ, বাকসা, ধেমাজি ইত্যাদি জেলায়, পশিমবঙ্গের উত্তরাংশে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলায়, মেঘালয়ের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম গারো পার্বত্য এলাকায় কোচ জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। এই জনজাতির মানুষ মূলত দ্বিভাষিক, মাতৃভাষা কোচ-এর পাশাপাশি এরা বাংলা, অসমিয়া, গারো,হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে অভ্যস্ত।
কোচ জনজাতি মেঘালয় রাজ্যে শিডিউলড-ট্রাইব অর্থাৎ তফশিলি উপজাতির মর্যাদা পেয়েছে। Kondakov (২০১৩) কোচ ভাষার ৬টি পৃথক প্রকারের কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন- ওয়ানাং, কোচা, হরিগয়া, মারগান, চাপড়া ও তিনতেকিয়া। Damant (১৮৮০) সর্বপ্রথম বোড়ো শাখার ভাষাগুলির একটি শ্রেণিবিভাগ করার সময় কোচ ভাষাকে কোচ-কাছারি উপশাখার অন্তর্ভুক্ত করেন। এই উপশাখার অন্যান্য ভাষাগুলি হলো- হোজাই, মেচ, রাভা, চুতিয়া এবং টিপ্পারা। Grierson (১৯০৩) এর মতে, কোচ ভাষা গারো উপশাখার অন্তর্ভুক্ত,যার অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য ভাষাগুলি হলো আচিক, আবেং, আতং ইত্যাদি। কোচ জনজাতির মধ্যে মোট ৯টি এথনোলিঙ্গুইস্টিক শাখার অস্তিত্ব রয়েছে, যেগুলির প্রত্যেকটিই কোচ ভাষার একএকটি পৃথক প্রকার এর ব্যবহার করে থাকে। উপরোক্ত ৬টি শাখা ছাড়াও অন্য ৩টিশাখা- সাতপারী, সংকর এবং বানাই- এরা প্রধানত হাজং ভাষা (যেটি একটি ভারতীয়-আর্য ভাষা) এবং ঝাড়ুয়া নামে একটি মিশ্রভাষা ব্যবহার করে থাকে, যার মধ্যে বাংলা, অসমিয়া ভাষার বৈশিষ্ট্য মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। কোচ ভাষার নিজস্ব কোন লিপির অস্তিত্ব নেই। অসমে বসবাসকারী কোচ জনজাতির মানুষ অসমিয়া লিপি এবং পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী কোচ জনজাতির মানুষ বাংলা লিপি লেখার কাজে ব্যবহার করেন। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় বসবাসকারী রাভা জনজাতির মানুষরা নিজেদের কোচ-রাভা নামে অভিহিত করেন এবং অসম রাজ্যে বসবাসকারী কোচ জনজাতির মানুষদের থেকে নিজেদের পৃথক জাতি হিসেবে গণ্য করেন।
Grierson (১৯৬৭) এর কাজে এবং Gait এর History of Assam (১৯৩৩) গ্রন্থে কোচ জনজাতি এবং তাদের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কোচ ভাষায় মোট ২৫টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি ভয়েসড-অ্যাসপিরেটেড এবং ১টি গ্লটাল-স্টপের সন্ধান পাওয়া যায়। কোচ ভাষার স্টপ ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির মধ্যে প্রধানত ভয়েসড ও ভয়েসলেস এবং অ্যাসপিরেটেড ও আনঅ্যাসপিরেটেড- এই দুটি কনট্রাস্ট লক্ষ্য করা যায়। কোচ ভাষায় সাধারণত ভয়েসড-অ্যাসপিরেটেড-স্টপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি দেখতে পাওয়া যায় না। ভারতীয়-আর্য ভাষাগুলির প্রভাবে কোচ ভাষার বেশ কিছু প্রকারের মধ্যে ভয়েসড-অ্যাসপিরেটেড-স্টপ ফোনিম, যেমন- /ভ/, /ধ/, /ঘ/, /ঝ/ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এগুলি প্রথমে ‘লোনওয়ার্ড’ শব্দের মাধ্যমে কোচ ভাষায় প্রবেশ করেছিলো। পরবর্তীকালে এই সমস্ত ফোনিমগুলি কোচ ভাষার নিজস্ব ফোনিম হিসেবে উঠে আসে এবং এই ভাষার নিজস্ব শব্দগুলিতেও স্থান করে নেয়। এবং সেইসঙ্গে বেশ কিছু লোনওয়ার্ড, যেখানে কোনো অ্যাসপিরেশন পূর্বে ছিলো না, সেখানেও এই ফোনিমগুলির প্রভাবে অ্যাসপিরেশনের প্রভাব শুরু হয়। এইভাবে কোচ ভাষার মধ্যে একটি ‘হাইপার-কারেকশন’ এর প্রবণতা তৈরি হয়। Joseph (২০০৭) এর মতে, এই একই ঘটনা রাভা ভাষার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তবে এই অ্যাসপিরেশন-ডিঅ্যাসপিরেশনের বিষয়টি কোচ ভাষার সমস্ত স্পিচ-ভ্যারাইটি অর্থাৎ প্রকারের ক্ষেত্রে সমভাবে দেখা যায় না। কোচ ভাষার হরিগয়া প্রকারটিতে এই ভাষার গ্লটাল-স্টপটি ‘মার্জিনাল-ফোনিম’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গ্লটাল-স্টপটি প্রধানত দুটি প্রতিধ্বনিত স্বরধ্বনির মাঝে বসে। এছাড়া কোচ ভাষার কিছু নিজস্ব শব্দ রয়েছে যেখানে এই গ্লটাল-স্টপ শব্দের অন্তর্গত নন-ফাইনাল সিলেবলের কোডা পজিশনে বসে। কোচ ভাষার মান্য বানানবিধি অনুসারে এই গ্লটাল স্টপ ব্যঞ্জনধ্বনিটি একটি ‘ (অ্যাপস্ট্রফি)এর মাধ্যমে বোঝানো হয়। এটি পূর্বে ব্যবহৃত কোনো বিশেষ ফোনিমের রেসিডিউ অথবা গারো ভাষায় ব্যবহৃত অপর কোনো ফোনিমের পরিবর্তিত রূপ কিনা সে সম্বন্ধে বিস্তারিত গবেষণার অবকাশ রয়েছে। কোচ ভাষায় মোট ৬টি স্বরধ্বনি রয়েছে। এই স্বরধ্বনিগুলির মধ্যে লেংথ অর্থাৎ দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে কোনো কনট্রাস্ট দেখতে পাওয়া যায় না। স্ট্রেসড ভাওয়েলের দৈর্ঘ্য আনস্ট্রেসড ভাওয়েলের তুলনায় কিছুটা বেশি হয়। মুক্ত এবং রুদ্ধ এই দুই প্রকার অক্ষরেই স্বরধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। Burling (২০০৯) এর মতে, এই ভাষার ষষ্ঠ ভাওয়েলটি সমগ্র বোড়ো-গারো ভাষাতত্ত্বেই একটি গুরুত্বপুর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। গারো ভাষার মতো কোচ ভাষাতেও কোনো কনট্রাস্টিভ টোনের অস্তিত্ব নেই। সমগ্র তিব্বত-বর্মীয় শাখার ভাষাগুলির সাপেক্ষে এই বৈশিষ্ট্যটি কিছুটা বিসদৃশ। যদিও অন্যান্য টোনাল ভাষার মতো কোচ ভাষাতেও সিলেবল অর্থাৎ অক্ষর এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোচ ভাষায় ৬ প্রকার সিলেবল প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়, যেমন- V, CV, VC, CVC, CCV, CCVC। সিলেবল অনসেট হিসেবে গ্লটাল-স্টপ ছাড়া অন্য যেকোনো ধ্বনিই ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু কোডা পজিশনে ভয়েসড-স্টপ, অ্যাসপিরেটেড-স্টপ ও অ্যাফ্রিকেট ব্যবহৃত হতে পারে না। এই ভাষায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ফোনোলজিকাল প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্পাইরান্টিজেশন, ভেলার স্টপ লোয়ারিং, কনসোনেন্ট লেনদেনিং ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রক্রিয়াই বৃহত্তর অর্থে অ্যাসিমিলেশন প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। এছাড়া সিলেবল স্ট্রাকচারের নিরিখে সিনকোপ, ডিসিলেবিফিকেশন, এপেন্থেসিস, ডিলিশন,ভাওয়েল-হারমোনি ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলি ঘটে থাকে। কোচ ভাষায় স্ট্রেস বিষয়টির ফোনেটিক কোরিলেট হিসেবে লেংথ এবং লাউডনেসের একটি সম্মিলিত রূপ কাজ করে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Census of India, 2011.
Kulung: A language of Nepal; Ethnologue.
Dattamajumdar, S. 2020. ETHNOLINGUISTIC VITALITY OF KOCH; Buckingham Journal of Languages and Linguistics
Koch; www.ethnologue.com
Kondakov, A. 2015. Harigaya Koch Phonology; North East Indian Linguistics 7. Asia-Pacific Linguistics
Kondakov, A. 2012. Koch Dialects of Meghalaya and Assam: A sociolinguistic survey. www.reseachgate.net