গারো ভাষা

গারো অথবা ‘আ-চিক্কু’ ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের ব্রহ্মপুত্র শাখার বোড়ো-গারো উপশাখার একটি ভাষা। মুলত গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মেঘালয় রাজ্য, অসম রাজ্যের কামরূপ ও গোয়ালপাড়া জেলা, নাগাল্যাণ্ড রাজ্যের কোহিমা জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলাতে বসবাসকারী গারো জনজাতির মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে ভারতে গারো জনজাতির মানুষের মোট সংখ্যা ১১৪৫৩২৩ জন, তবে এদের প্রত্যেকেই গারো ভাষায় স্বচ্ছন্দ নন। এই ভাষা লেখার জন্য বাংলা, অসমিয়া, ল্যাটিন এবং আ-চিক তোকব্রিম নামে একপ্রকার স্থানীয় লিপি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

গারো ভাষাকে বিশেষভাবে সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের তিব্বত-বর্মীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। বোড়ো-গারো উপশাখার অন্যান্য ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে বোড়ো, ককবরক, ডিমাসা, রাভা, আতং, তিওয়া ও কোচ ভাষা। এই ভাষাগুলি পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে ভাষাবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভাষাগুলির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। গারো ভাষার প্রকারগুলির মধ্যে আ-ওয়ে, আম-বেং, মাটচি, দুয়াল, গারা-গাঞ্চিং, চিসাক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে ‘আ-ওয়ে’ প্রকারটিকে গারো ভাষার মান্য প্রকার হিসেবে গণ্য করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে গারো পাহাড়ের উত্তর-পূর্বাংশে যখন জনজাতির মানুষ ছাড়াও বহিরাগত শিক্ষিত মানুষের আগমন ঘটে তখন খ্রিস্টান মিশনারিদের চেষ্টায় সর্বপ্রথম এই প্রকারটির বাংলা লিপি ব্যবহার করে লিখিত রূপ দেওয়া হয়। পরে এই প্রকারটি ক্রমশ গারো সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাংলা লিপির পরিবর্তে ল্যাটিন লিপির ব্যবহার শুরু হয়। ল্যাটিন নির্ভর আধুনিক গারো বর্ণমালাতে ২০টি বর্ণ রয়েছে এবং তার সঙ্গে ‘রাকা’ নামে একটি বিশেষ গ্লটাল-স্টপ এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই ‘রাকা’ কে ‘অ্যাপোস্ট্রফি’ ব্যবহারের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যেহেতু গারো ভাষা লেখার কাজে বাংলা ও অসমিয়া লিপি বহুলভাবে ব্যবহৃত হতো, তাই বর্তমানেও গারো ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রচুর বাংলা ও অসমিয়া শব্দের দেখা মেলে। আ-চিক-তোকব্রিম লিপিটি অপেক্ষাকৃত নতুন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে অরুণ রিটচিল-মারাক এই লিপিটির উদ্ভাবন ও উন্নতিসাধন করেন। গারো ভাষার প্রকার তথা উপভাষার ধারণাটি অনেকাংশে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। এখানে প্রকার বলতে ‘নন-অফিশিয়াল স্পিচ ভ্যারাইটি’ অর্থাৎ সরকারিভাবে অস্বীকৃত ভাষা-প্রকার বোঝায়। গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বাংশে সামসিং নদীর উপত্যকায় আতং প্রকারটি প্রচলিত। এছাড়া গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-মধ্য অংশে বুগাই নদীর উপত্যকায় রুগা প্রকারটি ব্যবহৃত হয়। গারো ও খাসিয়া পাহাড়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় মে-গাম প্রকারটি ব্যবহৃত হয়। গারো পাহাড়ের দক্ষিণাংশে গারা-গাঞ্চিং প্রকারটি ব্যবহৃত হয়। এই সমস্ত প্রকারগুলিই মিউচুয়ালি ইন্টেলিজিবল অর্থাৎ পরস্পরবোধ্য। মেঘালয় রাজ্যের গারো পার্বত্য অঞ্চলের ৫টি জেলায় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মেঘালয় রাজ্য ভাষা আইন অনুসারে সহকারী সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়। এই ভাষাটি গারো পার্বত্য এলাকার বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ফলে মেঘালয় রাজ্যে এই ভাষাটির অবস্থা উন্নত হলেও পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে গারো জনজাতির মানুষের জনবিরলতার কারণে এবং বাংলা, অসমিয়া, হিন্দি সহ অন্যান্য সরকারি ও আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবে এই ভাষাটির প্রভাব ও প্রয়োগ কমছে। উক্ত দুটি রাজ্যে গারো ভাষা সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটিতে গারো ভাষায় স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট করার সুযোগ রয়েছে। গারো ভাষায় অভিধান, ব্যাকরণ, অনুবাদ-সাহিত্য, সংবাদপত্র, গবেষণাগ্রন্থ ইত্যাদি মেঘালয় রাজ্যে নিয়মিত প্রকাশিত হলেও অপর দুই রাজ্যে এই ভাষার বিকাশের তেমন কোনো সুবিধা ও উদ্যোগ নেই।

গারো হলো একটি SOV ভাষা, অর্থাৎ এই ভাষায় কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া এই রীতিতে বাক্যগঠন করা হয়। সেদিক থেকে বাংলা ও অসমিয়া ভাষার সঙ্গে গারো ভাষার পদ-প্রকরণের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষায় সবকটি কেস অর্থাৎ কারকের অস্তিত্ব রয়েছে। এখানে নমিনেটিভ কেসের কোনো মার্কার থাকে না। অ্যাকুইজিটিভ কেসের মার্কার ‘–কো’, জেনিটিভ কেসের মার্কার ‘–নি’, ডেটিভ কেসের মার্কার ‘–না’, লোকেটিভ কেসের মার্কার ‘–ও’ এবং ‘–চি’, ইন্সট্রুমেণ্টাল কেসের মার্কার ‘–চি’ এবং কমিটিভ কেসের মার্কার হিসেবে ‘–মিং’ সাফিক্স ব্যবহৃত হয়। কিছু কিছু বিশেষ্য ভাওয়েল অর্থাৎ স্বরধ্বনি দিয়ে শেষ হয়। ইংরেজি ভাষার মতোই গারো ভাষায় উত্তম, মধ্যম ও প্রথম পুরুষের একবচন ও বহুবচনসূচক সর্বনামের ব্যবহার রয়েছে। উত্তম পুরুষে বহুবচনসূচক সর্বনাম হিসেবে ইনক্লুসিভ ও এক্সক্লুসিভ- এই দুই প্রকার ‘আমরা’ এর অস্তিত্ব গারো ভাষায় রয়েছে। গারো ভাষায় গ্রামাটিক্যাল জেন্ডার অর্থাৎ ব্যাকরণগত লিঙ্গের অস্তিত্ব নেই; এই কারণে এখানে প্রথম পুরুষ একবচনে কেবলমাত্র একটিই সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়। গারো ভাষায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-এই তিন প্রকার ক্রিয়ার কালের সূচক হিসেবে তিনটি পৃথক মার্কার, যথাক্রমে ‘–আহা’, ‘-আ’ ও ‘–গেন’ ব্যবহার করা হয়। এই ভাষায় ৫টি স্বরধ্বনি ও ১৭টি ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। বোড়ো-গারো শাখার অন্যান্য ভাষাগুলির মধ্যে হাই-লো টোনের পার্থক্য থাকলেও কেবলমাত্র গারো ভাষায় লো-টোন এর জায়গা নিয়েছে গ্লটাল-স্টপের ব্যবহার।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India- 2011

Burling, R. & Joseph, U.V. 2006; A Comparative Phonology of Boro Garo Languages. CIIL: Mysuru.

Marak, D. 2013 “Linguistic Ecology of Garo.” In Shailendra Kumar Singh (ed.) Linguistic Ecology of Meghalaya. EBH Publishers: Guwahati.

Watre, I & Angela, R. 2008; Garo Morphology, a descriptive analysis; NEHU.