উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নথির অভাবের কারণে, সাঁওতালদের আদি জন্মভূমি নিশ্চিতভাবে জানা নেই। নৃতাত্তিক গবেষকদের মতে, সাঁওতাল উপজাতি প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডের জাতিগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ১৮ শতকের মধ্যে, সাঁওতালরা, যাদের প্রাথমিক পেশা ছিল কৃষি, পূর্ববর্তী বিহারের (বর্তমানের ঝাড়খণ্ড) সাঁওতাল পরগণায় বসতি স্থাপন শুরু করে এবং ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিশের জারি করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অর্থাৎ পার্মানেন্ট ল্যান্ড সেটেল্মেন্টের পর সাঁওতালদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন শুরু করে সাঁওতালরা ১৯ শতকে। তারা জমিদার, মহাজন এবং ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচারের প্রতিবাদে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গঠন করে যার মধ্যে কৃষক, গ্রামবাসী এবং মহিলারাঅ ছিল। আন্দোলনটি শুরু হয় ১৮৫৫ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা এবং ভাগলপুর জেলায়। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব সহ আরো অনেকে।
সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। তবে সাঁওতাল মহিলারা পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সাঁওতাল উপজাতি ১১ টি টোটেম ভিত্তিক গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হল হাঁসদা, মুরমু, কিস্কু, হেমব্রোম, মার্ডি, সরেন, টুডু, বাস্কে, বেসরা, চঁড়ে, বেদেয়া এবং পাঁউরিয়া। বিয়ের পর মহিলারা স্বামীর গোত্রে অবস্থান করে এবং একই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ।
“সাঁওতালি ভাষা-চর্চা ও বিকাশের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে পরিমল হেমব্রম উল্লেখ করেছেন সাঁওতাল জাতির মধ্যে প্রচলিত ধর্মগুলিকে। মোট ১১টি প্রকার উল্লেখ করা আছে- যা হল সারি ধরম, সারনা ধরম, বাহা ধরম, খেরওয়াড় ধরম, জাহের ধরম, মারাংবুরু ধরম, হাঁড়ি ধরম, চাঁদোবোঙ্গা ধরম, যুগ ডাহার ধরম, সাধু ধরম, এবং আদিবাসী ধরম। তাদের কোন মন্দির বা উপাসনালয় নেই। সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সোহরাই, যা প্রতি বছর পৌষ মাসে ধনসম্পত্তি ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য পালন করা হয়। শিবেন্দুশেখর মিশ্র “সাঁওতাল সমাজ, সংস্কৃতি ও সংগ্রাম” বইতে লিখেছেন “সাঁওতালি ধর্মাচর্ণা, পূজাপাঠের অন্য নাম বোঙ্গাবুরু। বোঙ্গা শব্দ বাংলায় দেবতা আর বুরু অর্থে পাহাড় বা পর্বত— পৃথিবী বা ভূমি অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস দেবতারা উঁচু পর্বতে বাস করেন। যেখানে মানুষ সহজে যেতে পারে না। মারাংবুরু শব্দের অর্থ সবচেয়ে উঁচু পর্বত অর্থাৎ প্রধান দেবতা। তিনি জ্ঞানের দেবতা, জল, আশ্রয়, কৃষিকাজের দেবতা। তিনিই মহাদেব, তাই মহাদেবের আলাদা পূজার বিধান সাঁওতালদের মধ্যে নেই। সূর্যদেবতা হচ্ছে সিংবোঙ্গা বা সিঞবোঙ্গা। তিনি বৃষ্টি আনেন, কল্যাণ করেন, অন্ধকার দূর করে চারিদিক আলোকিত করেন। জমসিম উৎসবে তার উদ্দেশ্যে পূজা দেওয়া হয়। জাহের এরা মাতৃকা দেবী। খাদ্যশষ্য ফলানোর কৌশল জানেন তিনি। উর্বরতার প্রতীক। 'জা' শব্দের অর্থ বীজ বা অঙ্কুরোদ্গমের সুপ্ত ক্ষমতা, ‘এর’ অর্থ বপন করা। তিনি থাকেন জাহের থানে। প্রতিটি গ্রমে মাঁঝির বাড়ির কাছে জাহার থান আছে। একটি শাল্গাছের তলে মাটির উঁচু বেদী”। (পৃঃ ৭২-৭৩)
সাঁওতালি ভাষায় বিবাহকে বলা হয় ‘বাপলা’। আগেই বলা আছে, সগোত্র বিবাহ নিষিদ্ধ। এদের সমাজে বহুপ্রকার বিবাহ বিধি প্রচলিত আছে।
Census of India- 2011
https://doi.org/10.4324/9781315822433
Mishra, Shibendhushekhar (2017). Saotal Samaj Sanskriti o Sangram. Lok Sanskriti o Adivasi Sanskriti Kendra