দার্জিলিং জেলা
দার্জিলিং জেলা পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে পূর্ব হিমালয়ের পদপ্রান্তে অবস্থিত। দার্জিলিং জেলা বাংলাদেশ, নেপাল ও ভূটানের সীমান্তবর্তী; এছাড়া ভারতের সিকিম রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা দার্জিলিং জেলার নিকটে অবস্থিত। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জেলার মোট জনসংখ্যা ১৮৪৬৮২৩ জন এবং জনঘনত্বের নিরিখে দার্জিলিং জেলায় প্রতি বর্গকিমিতে সর্বনিম্ন সংখ্যক (৪১৩ জন/ বর্গকিমি) বসবাস করেন। দার্জিলিং জেলায় বাঙালি ও নেপালি জনগোষ্ঠির পাশাপাশি গোর্খা, লেপচা, ভুটিয়া, তামাং, লিম্বু, তিব্বতীয়, শেরপা, রাই প্রভৃতি জনজাতির মানুষ বসবাস করেন, এদের সহাবস্থানের মাধ্যমে এখানে একটি মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। এই জেলার অর্থনীতি মূলত চা উৎপাদন ও পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
দার্জিলিং জেলার প্রাচীনতম অধিবাসী হলো লেপচা অথবা রংপা জনজাতি। ব্রিটিশরা ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সিকিম রাজের থেকে দার্জিলিং অধিগ্রহণের পর নেপাল, সিকিম ইত্যাদি পার্বত্য এলাকা থেকে পরিযানের মাধ্যমে অন্য জনজাতির আগমন ঘটে, যাদের মূলত চা-শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো হতো। এছাড়া তিব্বতী ও দেশভাগের পর বাংলাদেশিরাও দার্জিলিং জেলায় বসতি গড়ে তোলে। দার্জিলিং জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা, হিন্দি, নেপালি ব্যবহৃত হলেও বানতাওয়া, বিজোরি, চামলিং, দোজাংখা, গুরুং খালিং, তামাং, লেপচা প্রভৃতি ভাষা জনজাতিগুলি ব্যবহার করে। এই ভাষাসমূহ মূলত সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত ও মূলত ধ্বনিপ্রধান। লেপচাদের নিজস্ব ভাষা ‘রং-রং’ নামে পরিচিত। লেপচা ভাষার নিজস্ব ও সম্পুর্ণ লিপি বর্তমান, সপ্তদশ শতাব্দীতে থেকং মেনসালং এর দ্বারা এই স্বতন্ত্র লিপির বিকাশ ঘটে। এই ভাষায় সম্পূর্ণ বিকশিত লিপির উপস্থিতির কারণে লেপচা জনজাতির নিজস্ব সাহিত্যকর্মেরও বিকাশ ঘটে। নুনান (২০১১) তামাঙ, গুরুং, থাকলি, মংপা, নারফু, তাংবে ইত্যাদি ভাষাকে তামাঙ্গিক (Tamangik) শ্রেণিভুক্ত করেছেন, যেটি তিব্বত-বর্মীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি শাখার একটি উপশাখা। তামাঙ ভাষা ‘তামাঙ টাম’ (Tamang Tam), ‘তামাঙ লেঙমো’ (Tamang Lengmo), ‘তামাঙ গৎ’ (Tamang Gyot) প্রভৃতি নামে পরিচিত। তামাঙ ভাষার দুটি উপভাষা বর্তমান-পশিমা তামাং ও পূর্বী তামাঙ, এই দুটি উপভাষার মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতা অনুপস্থিত। এই জনজাতির ভাষায় লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব খুব কম, এরা তিব্বতি ও দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করে; তবে তামাঙ জনজাতির মৌখিক ও লৌকিক উপকথা, গান ইত্যদির সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে যেখানে এই জনজাতির সমাজ, অর্থনীতি ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তামাঙ জনজাতির তাম্বা সম্প্রদায় ‘তাম্যিক লিপি’ (Tamyik script) ব্যবহার করে তামাঙ ভাষার নিজস্ব বই রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাম্যিক লিপি ‘নিখিল ভারত তামাঙ বৌদ্ধ পরিষদ’ (All India Tamang Buddhist Association-AITBA), ‘দার্জিলিং নেপাল তামাঙ গেদাং’, ‘সিকিম তামাঙ বৌদ্ধ পরিষদ’ ইত্যাদি সংগঠনের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এই সমস্ত জনজাতিগুলির নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকলেও বর্তমানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাবে ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে জনজাতির ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটছে। জনজাতি অধ্যুষিত দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের অংশ হওয়ায় দার্জিলিং জেলা ভাষাগত বৈচিত্রে উজ্জ্বল; কিন্তু ভাষাগুলির সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে জনজাতির ভাষাগুলি শিখতে নতুন প্রজন্ম আগ্রহী নয়। এই ভাষাগুলিতে নেপালি ও তিব্বতি শব্দের অনুপ্রবেশের ফলেও নিজস্ব ভাষারূপের বিকৃতি ও অবনমন ঘটেছে।
