পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

মুর্শিদাবাদ জেলা

ভাগীরথী নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ জেলার আয়তন ৫৩৪১ বর্গকিমি। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই জেলার জনসংখ্যা ৭০ লক্ষের কাছাকাছি (৭ মিলিয়ন) এবং জনঘনত্ব ১৩৩৪ জন/বর্গকিমি। এই জেলার উত্তরে মালদহ জেলা, পশ্চিমে বীরভূম, দক্ষিণ-পশ্চিমে বর্ধমান, দক্ষিণে নদীয়া জেলা ও পূর্বে বাংলাদেশের রাজসাহী জেলা অবস্থিত। এই জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি, রেশম শিল্প এবং কাঁসা ও পিতলের বাসনপত্র তৈরির উপর নির্ভরশীল।
মুর্শিদাবাদ জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা; তবে হিন্দি, উর্দু এবং ইংরেজিও ব্যবহার করা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রাম, রঘুনাথগঞ্জ এবং লাল্বাগ-মুর্শিদাবাদ ব্লকে ‘সাপেরা’ অথবা ‘বেদিয়া’ জনজাতির দেখা মেলে যারা তফশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত, প্রধানত হিন্দু এবং এদের মধ্যে ৪৩টি গোত্র বর্তমান। এরা অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় বাংলা ভাষা ব্যবহার করলেও নিজেদের মধ্যে এরা ‘মাংতা’ নামে একটি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। গ্রিয়ারসনের মতে, ‘মাংতা’র সঙ্গে ইউরোপীয় জিপসি ভাষার সামঞ্জস্য আছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা, রঘুনাথগঞ্জ ও সুতি ব্লকে খোট্টা ভাষার ব্যবহার আছে। খোট্টা ভাষা ‘মগহি’ এর একটি ভাষা প্রকার। খোট্টা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত প্রান্তিক চাষী, তবে এদের মাত্র ৩০ শতাংশের নিজস্ব জমি রয়েছে। এছাড়া ‘সারসাব্দিয়া’ নামে একটি মুসলিম জনজাতি মুর্শিদাবাদে দেখতে পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদ জেলায় সাঁওতাল জনজাতির মানুষও বসবাস করেন, যাদের নিজস্ব ভাষা, লিপি (অলচিকি, যা ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু তৈরি করেন) ও সাহিত্য রয়েছে এবং ভাষাটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি সরকারি ভাষা।
মুর্শিদাবাদ জেলার জনজাতিগুলির মধ্যে ‘রায়বেঁশে’ নামক একপ্রকার লোকশিল্পের প্রচলন আছে। একটি বৃহৎ বাঁশের সাহায্যে দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শিত হয়। এই নাচে শুধুমাত্র পুরুষরাই অংশ নেয়। ডানপায়ে নুপুর পরা এই নাচের একটি প্রচলিত প্রথা। নাচের মাধ্যমে, তীর ছোঁড়া, তলোয়ার ঘোরানো প্রভৃতি প্রদর্শিত হয়। রায়বেঁশে নাচের সাথে ঢোল ও কাঁসি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাঁওতাল জনজাতির প্রধান উৎসব ‘সোরহাই’ পৌষ মাসের শেষে বীরভূম, বর্ধমান ও মালদহের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলাতেও পালিত হয়। ‘সোরহায়ে’ শব্দের অর্থ হল ধন্যবাদ জ্ঞাপন। ‘উম হিলোক’ অর্থাৎ বসতবাড়ি পরিষ্কার করে, ২৫০ গ্রাম চাল, একমুঠো ডাল, তেল, নুন, আলু, রান্নার কাঠ ও একটি মোরগ দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এই উৎসবের মাধমে সাঁওতাল জনজাতি খাদ্যের সংস্থানের জন্য গান, নাচ এবং অন্যান্য ধর্মীয় রীতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতার উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জানায়। তবে বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার জনজাতিগুলির মধ্যে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও বাংলা, হিন্দি ভাষার ক্রমবিস্তারের কারণে ভাষিক ও লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবনমন ঘটছে।