নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে ধুরওয়া জনজাতিকে ‘গোন্ড’ জনজাতির একটি উপশাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই জনজাতির বেশিরভাগ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যই বর্তমানে নিকটবর্তী উচ্চবর্ণের মানুষের আচার ও ভাষা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশে গেছে। এরকমই একটি বিশেষ শ্রেণি হলো ভাত্রা, যারা ধুরওয়া জনজাতির থেকে সামাজিকভাবে উচ্চতর শ্রেণিতে অবস্থান করার ফলে এদের নিজস্ব ভাষা ভাতৃ-কে ধুরওয়া জনজাতির অনেক মানুষ নিজস্ব ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
‘ধুরওয়া’ শব্দটি ‘ধরা’ শব্দ থেকে এসেছে বলে ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন। বন থেকে সরীসৃপ, পাখি এবং অন্যান্য বন্য জন্তু শিকারই ছিলো এদের প্রধান জীবিকা; সেখান থেকে ‘ধুরওয়া’ শব্দের উৎপত্তি। এদের নিজস্ব ধর্ম হলো প্রকৃতিপূজা ও টোটেম উপাসনা। তবে এদের মধ্যে এখন বেশ কিছু হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ দেখা যায়। ফলে উক্ত প্রধান ধর্মগুলির বৈশিষ্ট্যসমূহ আদিবাসীদের লৌকিক ধর্মে প্রবেশ করেছে।
এদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ, প্রধান উৎপন্ন ফসল হলো ধান। তবে এই জনজাতির বেশিরভাগ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়াতে এদের নিজস্ব জমি নেই। মূলত পার্শ্ববর্তী উচ্চবর্ণের মানুষের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে এবং ভাগচাষের মাধ্যমে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও এই জনজাতির মানুষ নিজেরা তৈরি করতে পারে না। এগুলি এরা অন্য জাতির মানুষদের থেকে সাপ্তাহিক হাট থেকে সংগ্রহ করে। এছাড়া পূর্বে এরা রাজার সৈন্যবাহিনীতেও কাজ করতো। বাঁশের কাজেও এদের দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়। বন থেকে কাঠ, গাছের ছাল ও ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে এরা নিকটবর্তী হাটে অল্প মূল্যে বিক্রয় করেও জীবিকা অর্জন করে থাকে। এই জনজাতির মানুষ নিজেদের জামাকাপড়ও নিজেরা তৈরি করে। এদের ঘরবাড়িগুলি মূলত মাটি ও কাদা দিয়ে নির্মীত জানালাবিহীন কুঁড়েঘর। কিছু কিছু গ্রামবাসী পরস্পরের আত্মীয় না হয়েও পরিবর্ধিত পরিবার হিসেবে একত্রে বসবাস করে। এই প্রথাটি নিকটবর্তী গোন্ড জনজাতির প্রভাবে এদের মধ্যে চলে এসেছে বলে মনে করা হয়। এদের প্রত্যেকটি গ্রাম অনেকগুলি কুঁড়েঘরের সমন্বয়ে এবং একটি বৃহৎ খোলা জায়গা নিয়ে গঠিত, যেখানে জনজাতির নিজস্ব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি যেকোনো পারিবারিক ও সামাজিক বিবাদের মীমাংসা সভার মাধ্যমে করা হয়। গোত্রের প্রধানের অনুমতি ছাড়া এই জনজাতির কোনো মানুষ গ্রামের মধ্যে বসতি স্থাপন করতে পারে না। এই জনজাতির প্রধান পোশাক হলো পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুতি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে শাড়ি এবং ক্ষেত্রবিশেষে রুপো এবং অন্যান্য ধাতুনির্মীত গয়না।
এই জনজাতির মধ্যে একই গোত্রে বিবাহ স্বীকৃত নয়; বিবাহ মূলত দুই প্রকারের হয়, ‘চুর্চা’ ও ‘টিকা’। ‘চুর্চা’ বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাপণ দেওয়ার প্রথা রয়েছে। ‘টিকা’ বিবাহ তখনই অনুষ্ঠিত হয় যখন কোনো বিবাহবিচ্ছিন্ন অথবা বিধবা মহিলা পুনরায় বিবাহ করেন; অথবা ধুরওয়া জনজাতির কোনো পুরুষ বা মহিলা যখন উচ্চবর্ণের কোনো অপর লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের ক্ষেত্রে অনেকাংশে এই জনজাতি হিন্দু রীতিই অনুসরণ করে। এই জনজাতির বিবাহে সিঁদুরদান এবং মূল বিবাহের পূর্বে কন্যার সঙ্গে আমগাছের বিবাহ দেওয়ার রীতি রয়েছে। বিবাহের পর মূলত মেয়েদের ছেলের বাড়ি যেতে হয়।
এই জনজাতি মূলত ‘বড়ো’ ও ‘ছোটো’ নামে দুটি বিভাগে বিভক্ত। এই শ্রেণিবিভাগটি রক্তের বিশুদ্ধতার নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। এদের গোত্রগুলির মধ্যে আবার উপগোত্র ও বংশ নামে শ্রেণিবিভাগ বর্তমান। এই উপগোত্রগুলির নামের ক্ষেত্রে এরা লৌকিক হিন্দু ধর্মের নামকরণ রীতি অনুসরণ করে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে যেমন গোত্রের পরিচয় প্রাচীন ঋষিদের নাম অনুসারে হয়, তেমন এই জনজাতির গোত্রগুলিও ‘টোটেম’ এর নাম অনুসারে দেওয়া হয়। এরা অ্যানিমিজম অর্থাৎ প্রকৃতি, জীবজন্তু এবং টোটেম উপাসনায় বিশ্বাসী। এরা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস না রাখলেও আত্মা যে মৃত্যুর পর এক দেহ থেকে অপর কোনো দেহে পরিভ্রমণ করতে পারে, সেই ধারণায় বিশ্বাসী। এরা বিশ্বাস করে যে পৃথিবীতে করা ভালো অথবা খারাপ কাজের ভিত্তিতে একজন মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় কোনো মানুষ অথবা পশুর দেহ ধারণ করতে পারে। এদের বিশ্বাস অনুসারে, জন্তু, পাখি, গাছ এদের মধ্যেও আত্মার অস্তিত্ব আছে। ‘রাউ’ নামে এক দুষ্ট আত্মাকে এই জনজাতির মানুষ ভয় পায় এবং বিশ্বাস করে যে পাথর অথবা মাটির টুকরো ছুঁড়ে এই আত্মা মানুষের ক্ষতি করে। এরা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল এই তিন পৃথিবীর ধারণায় বিশ্বাসী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও পালনীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি বর্তমানে অনেকাংশেই লৌকিক হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত।
অন্য ধর্ম ও পার্শ্ববর্তী জনজাতির ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে এই জনজাতির নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমশ অবনমন ঘটছে।
Census of India- 2011
Stassen, Leon. 1997; Intransitive Predication. Oxford Studies in Typology and Linguistic Theory. Oxford University Press.
Trivedi, Anurag. 2020; India’s Tribal Communities- The Dharua Tribe of Odisha.