বালটি ভাষা
বালটি ভাষা সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের অন্তর্গত তিব্বত-কানাউরি শাখার লাদাখ-বালটি উপশাখার একটি ভাষা। এটি সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের অন্তর্গত হলেও এটি মূলত পাকিস্তানের গিলগিট-বালটিস্তান এবং ভারতের লাদাখ জেলার লে অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা। মান্য তিব্বতী ভাষা থেকে এই ভাষা অনেকাংশে পৃথক হলেও এখানে আদি তিব্বতি ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্যই বজায় রয়েছে।
বালটি ভাষার বহু-অক্ষরযুক্ত শব্দের ক্ষেত্রে একটি সরল পিচ-অ্যাকসেন্ট এর প্রয়োগ দেখা যায়। মূল তিব্বতি ভাষায় একটি অপেক্ষাকৃত জটিল পিচ-সিস্টেম বর্তমান, যেখানে টোন-কন্টুর এর ব্যবহার রয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই। লেখার কাজে তিব্বতি এবং পারস্য-আরবিক লিপি ব্যবহার করা হয়। লে, লাদাখ এবং পাকিস্তানের উক্ত অঞ্চল ছাড়াও বালটি ভাষা ভারতের উত্তরাখণ্ডের দেরাদুন, নৈনিতাল, শিমলা ইত্যাদি অঞ্চল এবং পশিমবঙ্গের কিছু অংশে বিচ্ছিন্নভাবে কথিত হয়।
বালটি ভাষার চারটি ভ্যারাইটি তথা প্রকার বর্তমান। এদের মধ্যে উচ্চারণগত কিছু পার্থক্য থাকলেও এরা মিউচুয়ালি ইন্টেলিজিবল অর্থাৎ পারস্পরিক বোধগম্য। এই চারটি প্রকার হলো- পূর্বী অর্থাৎ ইস্টার্ন, মধ্য অর্থাৎ সেন্ট্রাল, ওয়েস্টার্ন অর্থাৎ পশ্চিমা, এবং সাউদার্ন অর্থাৎ দক্ষিণী। এই উচ্চারণগত পার্থক্যগুলি একটি চার্টের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব-
ইংরেজি | পূর্বী প্রকার | মধ্য প্রকার | পশ্চিমা প্রকার | দক্ষিণী প্রকার |
---|---|---|---|---|
Milk | Oma | Oma | Ona | Oma |
Keep | Yuq | Yuq | Yuq | Juq |
Girl | Bono | Bono | Bono | Bono |
Mountain | Braq | Braq | Blaq | Blaq |
এই ভাষায় ৭টি স্বরধ্বনি এবং ৩৯টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। স্বরধ্বনিগুলি ফ্রন্ট, সেন্ট্রাল ও ব্যাক এবং ক্লোজ, মিড ও ওপেন- এই কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত। স্বরধ্বনিগুলির মধ্যে স্টপ (ভয়েসলেস, অ্যাস্পিরেটেড ও ভয়েসড), অ্যাফ্রিকেট (ভয়েসলেস, অ্যাস্পিরেটেড ও ভয়েসড),ফ্রিকেটিভ (ভয়েসলেস ও ভয়েসড), ন্যাসাল, ট্যাপ, ল্যাটারাল (প্লেন ও মারমারড) এবং অ্যাপ্রক্সিমেন্ট ব্যাঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। পূর্বে এই ভাষায় তিব্বতি লিপির ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও (অষ্টম থেকে ষোড়শ শতকে) বর্তমানে পারস্য-আরবিক লিপিই লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বালটি ভাষায় আরও দুই প্রকার লিপির অস্তিত্ব থাকলেও এগুলি বর্তমানে বিলুপ্ত। এছাড়া বর্তমানে এই ভাষায় রোমান ও দেবনাগরী লিপির ব্যবহারের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস তথা CIIL বালটি ভাষা লেখার কাজে রোমান লিপির ব্যবহারকে মান্যতা দিয়েছে। পুর্বে বালটি ভাষা লেখার কাজে তিব্বতি লিপির একটি স্থানীয় রূপ ব্যবহার করা হতো। এটি স্থানীয়ভাবে 'ইয়ুইগে’ নামে পরিচিত ছিলো। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আবাদি সর্বপ্রথম তিব্বতি লিপিতে চারটি এবং পারস্য লিপিতে সাতটি নতুন অক্ষরের প্রচলন করেন, যেগুলি বালটি ভাষাতেও প্রয়োজন অনুযায়ী গৃহীত হয়েছিলো। বর্তমানে ওই চারটি অক্ষরের মধ্যে দুটি তিব্বতীয় ইউনিকোড অ্যালফাবেটেও গৃহীত হয়েছে। বর্তমানে লাদাখি সংস্কৃতির সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বালটি ভাষার স্কলাররা তিব্বতিলিপির ব্যবহারে জোর দিয়েছেন। তবে বালটি ভাষায় বেশ কিছু শব্দের উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকার কারণে ইংরেজি এবং উর্দু শব্দভাণ্ডার থেকে বেশ কিছু শব্দ বালটি ভায়ায় প্রবেশ করেছে। বালটি ভাষায় তিব্বতি অনরিফিক অর্থাৎ সম্মানার্থক সর্বনামগুলি অবিকৃত অবস্থায় গৃহীত হয়েছে। বালটি ভাষায় একটি প্রবাদ-প্রবচনের সংকলন ছাড়া কোনো গদ্য সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই ভাষায় কিছু মৌখিক কাব্যের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই সমস্ত মৌখিক সাহিত্যই কবিতার আকারে রচিত। এই কবিতার ফর্ম মূলত পারসিক কবিতার ফর্মকেই অনুসরণ করে। ভারতের কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের গিলগিট উপত্যকা অঞ্চলে প্রচলিত অধিকাংশ ভাষা যেমন, পুশতু, সিনা,খোয়ার ইত্যাদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ভারতীয়-আর্য অথবা ইন্দো-ইরানীয় শাখার ভাষা হলেও বালটি ভাষা সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাগুলির তেমন কোনো ধ্বনিগত ও রূপগত সাদৃশ্য দেখা যায় না। কেবলমাত্র কতকগুলি লোন-ওয়ার্ড অন্যান্য ভাষা থেকে বালটি ভাষায় প্রবেশ করেছে। লাদাখি ভাষার সঙ্গে বালটি ভাষার উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। তিব্বতি ভাষার সঙ্গে বহুদিনের বিচ্ছিন্নতার কারণে বালটি ভাষার সঙ্গে তিব্বতির যোগসূত্র স্থাপনের বিষয়টি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে বালটি ভাষার উপর উর্দুভাষার (যেটি ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিল অনুযায়ী একটি স্বীকৃত সরকারি ভাষা) প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে প্রচলিত মান্য তিব্বতি লিপিটি বালটি ভাষায় ব্যবহৃত না হওয়ার কারণে বালটি ভাষার শব্দগুলির যথাযথ ট্রান্সক্রিপশন সম্ভব হয় না। এছাড়া বালটি জনজাতির মানুষদের মধ্যে নিজস্ব লিপির সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
গ্রন্থপঞ্জী :
Lobsang, G.H. 1995. A Short Sketch of Balti-English Grammar
Pandey, A. 2010. Introducing Another Script for Writing Balti
Rangan, K. 1975. Balti Phonetic Reader; CIIL
Read, A.F.C. 1934. Balti Grammar; Royal Asiatic Society, London