সাদরি ভাষা
সাদরি বা সাদানি বা নাগপুরী ভাষা প্রধানত ছোটনাগপুর এলাকায় ব্যবহৃত হয়, এছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যার কিছু অঞ্চলে এই ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। নাগপুরীয়া ভাষাকেই গ্রিয়ারসন (১৯০৩, ভাগ ৫, খণ্ড ২) সাদরি বা সাদানি ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন। সাদরি বা সাদানি ভাষা “সদন” (ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী একটি আর্য জনগোষ্ঠী) নামের এক জনজাতির মাতৃভাষা (সবিতা কিরণ, জন পিটারসন্, ২০১১)। বর্তমানে এই ভাষাটি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের চা-বাগান অঞ্চলে একটি ব্যবসায়িক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সাদরি বা সাদানি ভাষার সঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে পাঁচ-পরগনিয়া আর কুড়মালি ভাষার মিল পাওয়া যায়।
ভাষাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে এই ভাষাকে খারিয়া, মুন্ডা, ওঁরাও ও কুরুখ প্রভৃতি আদিবাসীদের lingua franca বা সেতু ভাষা হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
গ্রিয়ারসনের LSI (১৯০৩, ভাগ ৫, খণ্ড ২) অনুযায়ী সাদরি ভাষা একটি ইণ্ডো-আরিয়ান ভাষা। সাদরি কে অনেক সময় ভোজপুরী ভাষার একটি প্রকারভেদ বলে ধরা হয় কিন্তু এই তথ্যে সাদরি ভাষীরা সম্মতি জানায়নি। তাঁদের মতে সাদরি একটি স্বাধীন ভাষা বা হিন্দি ভাষার প্রকারভেদ। ভারতীয় সরকারি জনসংখ্যা অনুযায়ী এটি একটি হিন্দির প্রকারভেদ, ২০১১ সেনসাস অনুযায়ী ৫,১৩০০,০০০ জন সাদরি ভাষী বর্তমানে ভারতবর্ষে আছেন।
চা-বাগানে বাস করা অধিবাসী গোষ্ঠী নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরে খুব বেশি মেলামেশা করত না। একমাত্র চা বিক্রির সময় বাজারে তাঁদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনেদের সংস্পর্শে আসে এবং এই আন্ত সাম্প্রদায়িক গঠনের জন্যই তাঁদের মাত্রিভাসায় কথাবার্তা বলা প্রচলন হল। পরবর্তীকালে বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে যুগে যুগে এই ভাষার বিস্তার আরো প্রবল হয়েছে। এটি মূলত ব্যবসার কাজে ব্যবহার হওয়ার ফলে, দিনে দিনে এই ভাষার বৃদ্ধি সহজ হয়েছে। চা বাগানে কর্মরত সকল আদিবাসী গোষ্ঠীর এটি একটি সাধারণ ভাষা হওয়ার কারণে মুন্ডা, কোল, হো, টোটো এবং বাকি সব আদিবাসীবৃন্দরাই এই ভাষা খুব সহজে রপ্ত করে ফেলেছেন।
সাদরি ভাষা আসলে একটি কথ্য ভাষা কিন্তু পরবর্তীকালে এই ভাষার জনপ্রিয়তার ফলে এই ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয় এবং এই ভাষা লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়। এই ভাষাতে বহু সাহিত্য চর্চা হয়েছে এবং নিউ টেস্টামেন্ট কে অনুবাদ করা হয়েছে। সাদরি ভাষা প্রধানত দেবনাগরী স্ক্রিপ্টে লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। নাত্তয়াঁ বিহান নামক একটি পত্রিকায় সাদরি কবিতা, নাটক ও কাহিনী বঙ্গানুবাদ সহ ২০১৯ সালে সুন্দরবন আদিবাসী শিক্ষক সমিতি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
PLSI খণ্ড ৩১ ভাগ ৩ (২০১৭) অনুযায়ী সাদরি ভাষার স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭টি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ২৯টি কিন্তু ক্ষেত্রমোহন সরকার ১৯৯৫ সালে তাঁর Ph.D. গবেষণা পত্রে ৬টি স্বরধ্বনির কথা উল্লেখ করেছেন। এই স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ প্রকৃতি অনেকটা বাংলা আর হিন্দির মতন। এছাড়াও ব্যাকরণগত দিক দিয়ে বাংলা ও হিন্দির সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যায়।
একটি সাধারণ সাদরি বাক্যের গঠন কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া (S-O-V) , নীচে উদাহরণ দেওয়া হলঃ
রাম ছঁরিঠোকে দেখলাক
রাম মেয়েটাকে দেখল
সরকার (১৯৯৫) সাদরি কথ্য ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন এবং তিনি সাদরি ভাষার শব্দগুলিকে মূলত তিন প্রকারে ভাগ করেছেন, যথা মৌলিক বা সিদ্ধ শব্দ, জটিল বা মিশ্র শব্দ, যৌগিক বা সমাস বদ্ধ শব্দ। তিনি সাদরি ভাষার রূপমূলগুলিকে দুই প্রকারে ভাগ করেছেন; মুক্ত বা স্বচ্ছন্দ রূপমূল (Free Morpheme) এবং বদ্ধ বা আশ্রিত রূপমূল (Bound Morpheme)। সাদরি ভাষায় পদ প্রকরণ পাঁচ প্রকার, যা হলো বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় আর ক্রিয়া। বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনামের রূপ বৈচিত্র্য তিন প্রকারের- লিঙ্গ, বচন, কারক বিভক্তি। ক্রিয়ার রূপ বৈচিত্র্য পাঁচ প্রকারের তথা কাল, ভাব, প্রকার, বাচ্য এবং পুরুষ।
অন্যান্য আদিবাসী ভাষাগুলির মতনই সাদরি ভাষায় রোজকার ব্যবহৃত বস্তুবিশেষ ও যন্ত্রপাতির জন্য আলাদা শব্দ আছে তবে এটি একটি সেতু ভাষা (lingua franca) হওয়ার কারণে এই ভাষায় loan words বা ধার করা শব্দের সংখ্যা বেশী। বাংলা, হিন্দি এবং অন্যান্য আদিবাসী ভাষার অনেক শব্দের ব্যবহার এই ভাষায় হয়।
গ্রন্থপঞ্জী :
Dey, L. (2011). Argument Selection in Sadani/Sadri as spoken in Assam. Tezpur University.
Grierson, G. A. (1903). Linguistic Survey in India Vol.5, Part 3.
Kiran, S., & Peterson, J. (2011). Sadri/Sadani. Retrieved March 9, 2020, from http://www.southasiaগ্রন্থপঞ্জী:.de/uploads/Sadri.pdf.
Sarkar, B. C., & Oraon, N. (2017). Sadri. In G. Devi, S. P. Singha, & I. Acharya (Eds.), People's Linguistic Survey in India ,Paschimbanger Bhasa , Vol-31, Part-3 (pp. 492-509). Orient Black Swan.
Sarkar, K. (1995). Sadri Speech: A Phonetic and Morphological Study. Uttarbanga University.