পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

লোথা সংস্কৃতি

ঐতিহাসিকদের মতে, লোথা জনজাতি মাঞ্চুরিয়া প্রদেশ থেকে পরিযানের মাধ্যমে হিমালয় পর্বতের পাদদেশ ধরে এগিয়ে প্রথমে বর্তমান মায়ানমার ও মণিপুর রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে মণিপুর থেকে পুনরায় পরিযানের মাধ্যমে তারা বর্তমান নাগাল্যাণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বসতি স্থাপন করে। অপর একটি উল্লেখযোগ্য মত হলো, লোথা, সাংতাম, রেংমা ও সুমি- এই ৪টি জনজাতি পূর্বে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পরবর্তীকালে সাংতাম, রেংমা ও লোথা জনজাতি পরস্পর পৃথক হয়ে আলাদা জায়গায় বসতি গড়ে তোলে। ফলে এদের মধ্যে অঞ্চলগত কারণে বেশ কিছু পৃথক বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে।

লোথা জনজাতির নিজস্ব ঘরবাড়ি ‘ওখা’ নামে পরিচিত। এছাড়া এদের পোশাকেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই সামাজিক মর্যাদার সূচক হিসেবে বিশেষপ্রকার শাল ব্যবহারের প্রথা প্রচলিত রয়েছে। মহিলা ও পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট শাল যথাক্রমে ‘ওপভুরাম’ এবং ‘লঙপেনসু’ নামে পরিচিত। পূর্বে শিকার তথা হেড-হান্টিং এদের প্রধান জীবিকা থাকলেও খ্রিষ্টানধর্মের প্রচলনের পর এই প্রথা অনেকাংশে পরিত্যক্ত হয়েছে। এই জনজাতি মূলত ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান হলেও এদের মধ্যে অল্প কিছু ক্যাথলিক ধর্ম অনুসরণকারী খ্রিষ্টানও রয়েছে। এদের মধ্যে প্রচলিত প্রধান দুটি উৎসব হলো ‘তোখু-এমং’ এবং ‘পিখুচাক'। ‘তোখু-এমং' উৎসবটি প্রতি বছর ৭’নভেম্বর পালিত হয়। এটি ফসল তোলার সময় পালিত উৎসব, যা প্রায় ৯ দিন ধরে পালিত হয়। এই উৎসবে বন্ধুদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ১২ টুকরো মাংস আদানপ্রদানের প্রথা রয়েছে। এই উৎসব পালনের সময় লোথা ব্যাতীত অপর কোনো জনজাতির মানুষ লোথা সম্প্রদায়ের গ্রামে উপস্থিত থাকলে সূর্যাস্তের আগে তাকে সেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়; অথবা উৎসব সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি অর্থাৎ ৯’দিন তাকে ওই গ্রামেই অবস্থান করতে হয়। এই উৎসবটি একজন পুরোহিত পরিচসালনা করেন, যিনি গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল সংগ্রহ করে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। এই জনজাতির বিবাহের অনুষ্ঠান এই উৎসব চলাকালীন বন্ধ থাকে।

নাগাল্যান্ডের ওখা জেলার প্রাচীন অধিবাসী ১৬টি জনজাতির একটি হলো লোথা জনজাতি। এদের জীবন মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। এদের গ্রামের প্রধান ‘এখুং' নামে পরিচিত। এই প্রধানকে গ্রাম পরিচালনার কাজে বয়স্ক মানুষদের নিয়ে গঠিত একটি গ্রামসংসদ সাহায্য করে থাকে। এই গ্রামসংসদটি ‘তঙটি চোচাং’ নামে পরিচিত। এই এখুং অর্থাৎ গ্রামপ্রধান উত্তরাধিকারসূত্রে নির্বাচিত হন না, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের উপর নির্ভর করে একে নির্বাচন করা হয়। ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে লোথা জনজাতি অলিখিত কিছু আইনের মাধ্যমে নিজেদের পরিচালনা করতো। এই আইনগুলির সংকলন ‘পিমতসুমোতসুই শিখু’ নামে পরিচিত। লোথা সমাজে গ্রামের অধিবাসীরা তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত- ‘এসাপভুই' অর্থাৎ শাসক, ‘এখো এখুং’ অর্থাৎ প্রভাবশালী মানুষ এবং ‘আরুশুরুই' অর্থাৎ সাধারণ মানুষ। লোথা জনজাতির মধ্যে অবিবাহিত যুবকদের জন্য পৃথক ডর্মিটরিতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে যা ‘চুম্পো’ অথবা ‘মোরাং’ নামে পরিচিত। এখানে এদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। লোথা সমাজ প্রকৃতিগতভাবে পেট্রিলিনিয়াল ও পেট্রিয়ার্কাল। কিন্তু লোথা সমাজে কোনোভাবেই মহিলাদের অবমাননা করা হয় না। তবে এদের সমাজে স্থাবর এবং অস্থাবর- কোনয়প্রকার সম্পত্তির উপরেই মহিলাদের কোনো উত্তরাধিকার স্বীকার করা হয় না। মহিলারা গ্রামসংসদে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করারও সুযোগ পান না। এদের সমাজে মূলত মনোগ্যামি অর্থাৎ একগামীতাই প্রচলিত। বিবাহবিচ্ছেদ প্রথাকে সাধারণত উৎসাহিত করা হয় না।

লোথা সমাজের অপর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘ওশো’, যাকে ‘ফিস্ট অফ মেরিট’ বলা হয়। এই প্রথা এদের গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিক জীবনকেই প্রতিফলিত করে। ভালো ফসল উৎপাদন, শিকার ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই ফিস্ট অর্থাৎ ভোজের মাধ্যমে এরা সাফল্য উদযাপন করে থাকে। ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে এদের মধ্যে প্রাচীন অ্যানিমিস্ট ধর্ম এবং টোটেম উপাসনার প্রথা প্রচলিত ছিলো। এই জনজাতি ডেভিল অর্থাৎ অপদেবতার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করে। তবে খ্রিষ্টানধর্মের প্রবর্তনের পর থেকে এদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার বিকাশ ঘটে। ফলে এদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। সরকারি ভাষাগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবে লোথা ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলিও ক্রমশ অবলুপ্ত হতে থাকে। মণিপুরি, নাগামিজ, অসমীয়া, বাংলা ইত্যাদি সরকারি ভাষাগুলির প্রচুর শব্দ লোথা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া ঘনসন্নিবিষ্ট জনবসতির অভাবে নাগাল্যান্ডের বাইরে এদের কোনো ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি। ফলে এই জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণও সম্ভব হচ্ছে না। লিপির অভাবের কারণে এই জনজাতির কোনো লিপিনদ্ধ সময়ানুক্রমিক ইতিহাস এবং ভাষার বিবর্তন সংক্রান্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। ইউনেস্কোর ভারতীয় বিপন্ন ভাষাসমূহের তালিকায় লোথা ভাষা ‘ভালনারেবল' শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে; অর্থাৎ ভাষাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে কেবলমাত্র পারিবারিক পর্যায়ে অর্থাৎ বাড়ির ভিতরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং পূর্ব প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ভাষাটি সঠিকভাবে সঞ্চারিত হয়নি।

গ্রন্থপঞ্জী:

Basu, J. Et al. 2016. Experimental Study of Vowels in Nagamese, Ao and Lotha: Languages of Nagaland. CDAC, Kolkata

Bruhn, D.W. A Phonological Reconstruction of Porto-Central Naga; PhD Thesis, University of California, Berkley

Census of India- 2001

Ezung, M. 2014. Traditional Religion of the Lotha-Nagas and the Impact of Christianity; PhD Thesis, Nagaland University.