জৌ ভাষা

জৌ ভাষা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের কুকি-চিন-মিজো শাখার উত্তর উপশাখার একটি ভাষা। ভাষাটি মূলত মণিপুর রাজ্যের সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিম মায়ানমারে প্রচলিত হলেও ভারতের মণিপুর, মিজোরাম, অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে প্রচলিত। এই ভাষা ব্যবহারকারী জনজাতিটিও জো বা জৌ নামেই পরিচিত। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের মোট সংখ্যা ১৮০০০০। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, লেখার কাজে ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স অংশে অর্থাৎ দার্জিলিং-হিমালয়ের পাদদেশে এই জনজাতি অন্যান্য পার্বত্য জনজাতির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় বসবাস করে।

জৌ ভাষায় মোট ৭টি স্বরধ্বনি এবং ২৩টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। স্বরধ্বনি অর্থাৎ ভাওয়েলগুলি আনরাউন্ডেড ও রাউন্ডেড এবং ওপেন-ব্যাক, ক্লোজ-মিড ব্যাক ও মিড-ব্যাক এই কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত। ৭টি স্বরধ্বনির প্রত্যেকটিই শব্দের প্রথমে, মাঝে অথবা শেষে বসতে পারে। কিন্তু /e/ এবং /a/- এই দুটি স্বরধ্বনির শব্দের প্রথমে ব্যবহৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলনামূলক কম। নিকটবর্তী অবস্থানে থাকা স্বরধ্বনি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং টোন-এই কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্বরধ্বনিগুলির বেশ কয়েকটি অ্যালোফোনের অস্তিত্ব রয়েছে। ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি স্টপ (অ্যাস্পিরেটেড ও আনঅ্যাস্পিরেটেড), অ্যাফ্রিকেট, ফ্রিকেটিভ, ন্যাসাল ও অ্যাপ্রক্সিমেন্ট- এই কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত। অন্যান্য সিনো-তিব্বতীয় ভাষার মতো জৌ ভাষাতেও গ্লটাল-স্টপ উপস্থিত। এই ভাষায় মোট ৮টি ডিপথং-এর অস্তিত্ব রয়েছে। জৌ ভাষার ভার্ব অর্থাৎ ক্রিয়াপদ ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত, যেগুলি হলো যথাক্রমে স্টেম-১, স্টেম-২, স্টেম-৩ ও স্টেম-৪। জৌ ভাষা প্রধানত মনোসিলেবিক এবং আংশিকভাবে অ্যাগ্লুটিনেটিং প্রকৃতির। টোন হলো জৌ ভাষার একটি সুপ্রা-সেগমেন্টাল বৈশিষ্ট্য। এই ভাষার টোন সিলেবলের মধ্যেই নিহিত থাকে। এর টোনাল রাইমের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ প্রকৃতি নিহিত থাকে, যেমন-

১) শর্ট/ল্যাক্স এবং লং/টেনস ভাওয়েল কোয়ালিটি

২) গ্লাইড (ডিপথং অথবা ট্রিপথং), যেগুলি পৃথকভাবে রাইজিং, মিড এবং লো টোন হিসেবে পরিচিত হয়

লেক্সিকাল ফোনোলজি অনুসারে এই ভাষার প্রধান টোনগুলির মধ্যে ল্যাক্স ভাওয়েল (শর্ট ভাওয়েল/মনোপথং) অথবা টেনস ভাওয়েল (ডিপথং/ট্রিপথং) থাকে যেটি সিলেবলের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। এখানে মোট ৩টি টোন রয়েছে- লেভেল, লো-রাইজিং এবং ফলিং। এদের মধ্যে লেভেল টোন আনমার্কড অবস্থায় থাকে। জৌ ভাষায় ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যার জন্য নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করা হলেও এগারো থেকে যৌগিক শব্দ ব্যবহার করা হয়। খ্রিষ্টান মিশনারি J.H. Cope ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ সর্বপ্রথম জৌ ভাষার জন্য ল্যাটিন লিপির প্রবর্তন করেন। M. Siahzathang জৌ ভাষার জন্য একটি স্বতন্ত্র লিপি অর্থাৎ স্ক্রিপ্ট গড়ে তোলেন, যা ‘জোলাই' নামে পরিচিত। এটি প্রধানত একটি অ্যালফাবেটিক সিস্টেম, যার মধ্যে কিছু অ্যালফাসিলেবিক বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে জৌ জনজাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে এই লিপির ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এই ভাষার সঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে মিজোরাম রাজ্যের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসেবে পরিচিত লুসাই অথবা ‘দুহ্লিয়ান’ ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। ভারতে প্রচলিত কুকিচিন ভাষাগুলির মধ্যে জৌ ভাষার সঙ্গে ‘পাইতে’ ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে; যদিও পাইতে ভাষায় উপস্থিত শব্দের অন্তঃস্থ গ্লটাল স্টপটি জৌ ভাষায় অনুপস্থিত।

গ্রন্থপঞ্জী :

Census of India- 2011

Singh, C.Y. & Himmat, L. 2013. Zou Phonology. Language in India

Pandey, A. 2010. Introducing the Zoo Script

Thanglienmang, Dr. P. Genetic Classification of the Zo Language and overview of Kuki-Chin languages

Thanglienmang, Dr. P. 2012. A Descriptive Grammar of the Zo language. academia.edu

Zou, www.ethnologue.com