লাখের ভাষা
লাখের অথবা মারা হলো সিনো-তিব্বতীয় ভাষাগোষ্ঠীর কুকি-চিন শাখার মারাইক উপশাখার একটি ভাষা। প্রধানত দক্ষিণ মিজোরামের ছিমতুইপুই জেলায় বসবাসকারী লোসাই জনজাতির মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন। এছাড়া এই অঞ্চলের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের গ্রামগুলি, অসম রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে অবস্থিত জলপাইগুড়ি জেলায় এই জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৪০০,০০০। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপির অস্তিত্ব নেই, লেখার কাজে মূলত ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করা হয়।
এই ভাষার কতকগুলি ভ্যারাইটি তথা প্রকারের অস্তিত্ব রয়েছে, যেমন- লোসাই-সিয়াহা (যেটি লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয়),লোসাই-সাইকাও, লোসাই-টোকালো ইত্যাদি। এই প্রকারগুলি পরস্পরবোধ্য অর্থাৎ মিউচুয়ালি-ইন্টেলিজিবল। এদের ৬টি শাখা আলাদা আলাদা প্রকার অর্থাৎ ভ্যারাইটির ব্যবহার করে। এই ভাষায় মোট ২৪টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। এছাড়া লাখের ভাষায় ৭টি ডিপথং রয়েছে। এদের ভাষাটি সিনো-তিব্বতীয় ভাষাবংশের অন্তর্গত হওয়ার ফলে এই জনজাতির ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ‘টোনাল ফিচার’। লাখের ভাষায় ৪টি টোন- রাইজিং, ফলিং, লেভেল এবং ফলিং-রাইজিং-এর অস্তিত্ব রয়েছে। ফ্রেডেরিখ উইলিয়াম সাভিজ নামে একজন খ্রিস্টান মিশনারি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ সর্বপ্রথম ল্যাটিন ভাষায় A Grammar and dictionary of the Lakher Language বইটি রচনা করেন, যেখানে লাখের ভাষার ব্যাকরণ এবং শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মতান্তরে এই বইটির রচয়িতা হলেন রেজিন্যাল্ড আর্থার লোরাইন নামে অপর এক ব্যক্তি, যিনি ‘লাখের পাইয়োনিয়ার মিশন’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে লাখের জনজাতির সাক্ষরতার সূচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ অসম সরকার বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নেয়। এই খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো লাখের জনজাতির ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে মারা তথা লাখের ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ। মারা ভাষায় এই অনুবাদের প্রধান অসুবিধা ছিলো এই যে, এই ভাষার সমস্ত শব্দের অন্তঃস্থ ব্যঞ্জনধ্বনিই বিলুপ্ত হয়েছে। গ্রিয়ারসন (১৯২৮) এর মতে,লাখের ভাষা হলো বৃহত্তর লাই ভাষার একটি ভ্যারাইটি তথা প্রকার। যদিও লুসাই ভাষার বর্ণগুলিকে টোনসূচক ডায়াক্রিটিক মার্ক ছাড়া লিখলে কনটেক্সট অনুযায়ী তার অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব, কিন্তু টোনাল ডায়াক্রিটিক মার্ক ছাড়া মারা অথবা লাখের ভাষার শব্দ লিখলে তাদের বর্ণগত সাদৃশ্য থাকলেও অর্থ পৃথক হয়ে যায়। লোরাইন এবং সাভিজ- দুজনেই মারা ভাষায় টোনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মারা জনজাতির মানুষ নিজেরাই অন্তত একটি টোনকে নিজেদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্টহয়েছিলেন। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যেসমস্ত সিলেবল লো-টোনে উচ্চারিত হয়, তাদের শেষে একটি ‘h’ অর্থাৎ ‘হ' উচ্চারিত হয়। ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে এই পদ্ধতিটি সঠিক হলেও, এর ফলে লাখের ভাষা মাতৃভাষা নয়, এমন মানুষদের কছে এই ভাষার শব্দ উচ্চারণ কঠিনতর হয়ে পড়ে। মারা ভাষায় অ্যাসপিরেটেড ন্যাসাল এবং ল্যাটারাল ব্যঞ্জনধ্বনির অস্তিত্ব রয়েছে। আবার এই ভাষায় যেকোনো একটি শব্দের সাহায্যে যেকোনো একটি নির্দিষ্ট ধারণা বোঝাতে যেকোনো একটি নির্দিষ্ট সিলেবলের ব্যবহার করা হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে,যেখানে শব্দমধ্যস্থ দ্বিতীয় সিলেবলটি ন্যাসাল অথবা ল্যাটারাল ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে আরম্ভ হয়, সেক্ষেত্রে একমাত্র লাখের ভাষার নেটিভ স্পিকার পক্ষে বোঝা সম্ভব যে, ওই ‘h’ অর্থাৎ ‘হ’ শেষ টোন-মার্ক হিসেবে প্রথম সিলেবলের অন্তর্ভুক্ত, অথবা শব্দের শুরুতে আগত অ্যাসপিরেশনের চিহ্ন হিসেবে দ্বিতীয় সিলেবলের অন্তর্ভুক্ত। লোরাইন এই শব্দের অন্তঃস্থ ‘h’ অর্থাৎ ‘হ’ কে গ্লটাল-স্টপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যে ধারণাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে। প্ররকৃতপক্ষে মারা অথবা লাখের ভাষায় পৃথকভাবে শব্দের অন্তঃস্থ কোনো গ্লটাল-স্টপের অস্তিত্ব নেই। লোরাইন সারকামফিক্স সহ আর একটি বর্ণ ব্যবহার করেন যেটিকে ‘o’ এর একটি দীর্ঘ অর্থাৎ লঙ ভ্যারিয়ান্ট হিসেবে দেখা যেতে পারে। এর প্রতিরূপ হিসেবে সাভিজ /ong/ এবং /ang/ ব্যবহার করেছিলেন। আসলে লোরাইন এবং সাভিজের এই শ্রেণিবিভাগ ল্যাটিন ভাষার ৫টি স্বরধ্বনির নিরিখে করা হয়েছিলো, যা মারা ভাষায় ব্যবহৃত ৭টি স্বরধ্বনিযুক্ত সিস্টেমের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই জনজাতির বেশিরভাগ মানুষ দ্বিভাষিক অথবা ত্রিভাষিক। নিজেদের ভাষা মারা অথবা লাখের ছাড়াও এরা মিজোরামের সরকারি ভাষা মিজো, অসম ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা অসমিয়া এবং বাংলা এবং এদের মায়ানমারে বসবাসকারী অংশ আরাকান পার্বত্য অংশে প্রচলিত লুসাই এবং অন্যান্য জনজাতির ভাষায় দক্ষ। এই জনজাতির মানুষ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় এখনও লাখের ভাষা ব্যবহার করলেও অন্য জনজাতির সঙ্গে বাক্যালাপের সময় ইংরেজি এবং অন্যান্য সরকারি ভাষার ব্যবহার করে থাকেন।
গ্রন্থপঞ্জী :
Lakher;ENCYCLOPEDIA.COM
Chhuanawma, L.H. 2020. Ethnic Affinities between Pawi (Lai) and Lakher (Mara) Tribes. www.ijcrt.org
Census of India- 2011
Lorrain, R.A. 1951. Grammar and dictionary of the Lakher or Mara language. Dept. Of Historical and Antiquarian Studies, Govt. of Assam.
Mara; www.ethnologue.com
Zohra, Dr. K. An Introductory notes to Mara District of South Mizoram, India