পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

গোন্ডি সংস্কৃতি

গোন্ড জনজাতি মূলত ভারতের দাক্ষিণাত্যের মালভূমির অন্তর্গত পার্বত্য এলাকার অধিবাসী, যাদের আদি বাসস্থান সাতপুরা পর্বত এবং বস্তার মালভূমির জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকা। এরা জঙ্গলকেন্দ্রিক নোম্যাডিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ‘কাদো’ এবং ‘কুটকি’ নামে দুই বিশেষ প্রকার মিলেট জাতীয় শস্য এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল। তবে এই মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের পার্বত্য এলাকায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির আধিপত্য থাকায় সেনসাস অর্থাৎ জনগণনার কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়নি। ফলে এদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্যের অভাব রয়েছে।

গোন্ড জনজাতির নিজস্ব মৌখিক লোককথা ও উপকথার ঐতিহ্য রয়েছে। গোন্ড সমাজে এই লোককথা শুনিয়ে জীবিকা অর্জনের প্রথাও বর্তমান। যারা এভাবে জীবিকা অর্জন করেন তাঁদের ‘প্রধান’ বলা হয়। গোন্ড সমাজের প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, গোন্ড দেবতাদের জন্মের পর তাদের মা তাদের পরিত্যাগ করলে পার্বতী তাদের উদ্ধার করেন। কিন্তু শিব তাদের একটি গুহার মধ্যে বন্দী করে রাখেন। তখন পাহান্ডি কাপার লিঙ্গাল নামে একজন গোন্ড বীর ‘জাঙ্গু বাঈ’ নামে এক দেবীর সহায়তায় তাদের মুক্ত করলে ঐ গুহা থেকে তারা চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। এই কারণে গোন্ড সমাজে চারটি বিভাগের জন্ম হয়।

গোন্ড জনজাতির নিজস্ব ধর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘পেরসা পেন’। অন্যান্য জনজাতির মতোই গোন্ড জনজাতিও একজন প্রধান দেবতার উপাসনা করে, যাকে ‘বড়োদেও’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ‘বড়োদেও’ই ‘পেরসা পেন’ নামে পরিচিত। এদের প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব প্রধান দেবতাও ‘পেরসা পেন’ নামে পরিচিত। সাধারণত এই ‘পেরসা পেন’ কে কল্যাণকর বলে মনে করা হলেও তিনি স্থানবিশেষে বিপজ্জনক এবং হিংস্র রূপ ধারণ করতে পারেন। গোন্ড সমাজের পুরোহিত ‘দেভারি’ নামে পরিচিত, যিনি সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। প্রধান দেবতা ছাড়াও এরা নিজেদের গৃহদেবতা, ফসলের দেবতা এমনকি গবাদি পশুকেও দেবতা হিসেবে পূজা করে। সমস্ত রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শীতলা পূজাও গোন্ড সমাজে প্রচলিত। এই বিষয়টির মাধ্যমে গোন্ড জনজাতির উপর হিন্দুধর্মের লৌকিক দেবতাদের প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এছাড়া গোন্ড জনজাতির মানুষ বিশেষ কয়েক প্রকার আত্মারও উপাসনা করে। প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব পুরোহিত বর্তমান, যিনি ‘কাটোরা’ নামে পরিচিত। এই জনজাতি প্রধানত মহিলা দেবতাদের উদ্দেশ্যে মুরগি, ছাগল এবং মহিষ উৎসর্গ করে। প্রতি ৯ অথবা ১২ বছর অন্তর ‘লারু কাজ’ নামক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ‘নারায়ণ দেও’ নামক দেবতার উদ্দেশ্যে একটি শুকর বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। এদের বেশিরভাগ উৎসব কৃষিকাজের সঙ্গে সংযুক্ত। ‘পোলা’ নামক গবাদি পশুর উপাসনার উৎসব এবং নাগপঞ্চমীও এদের মধ্যে প্রচলিত। এছাড়া দশেরা এবং এক বিশেষ প্রকার লাঠি নাচ গোন্ড সমাজে প্রচলিত।

গোন্ড সমাজের প্রধান ‘মুখিয়া’ বা ‘মাঝি’ নামে পরিচিত; যিনি একটি গ্রামসংসদ বা ‘পঞ্চায়েতের’ মাধ্যমে সমস্ত সামাজিক নিয়মনীতির পালনের উপর নজর রাখেন। এই গ্রামসংসদটি মুখিয়া, পুরোহিত, গ্রামের পাহারাদার এবং চারজন বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হয়।

গোন্ড জনজাতির সামাজিক জীবনের একটি বিশেষ দিক হলো ‘ঘোটুল’ প্রথা। এই প্রথা অনুসারে গোন্ড সমাজের অবিবাহিত যুবক ও যুবতীদের একটি ডর্মিটরির মতো স্থানে একত্রে রাখা হয়, এবং তারা মেলামেশার মাধ্যমে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারে। এছাড়া দক্ষিণ ভারতীয় প্রথা হিসেবে ক্রস-কাজিন ম্যারেজ অর্থাৎ তুতো ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহের প্রথা গোন্ড সমাজে প্রচলিত। এছাড়া এখানে তাদের গোন্ড সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কেও শিক্ষিত করে তোলা হয়। ঘোটুলে অবস্থানকারী ছেলেদের ‘চেলিক’ এবং মেয়েদের ‘মোতিয়ারি’ বলা হয়। ঘোটুল গোন্ড সমাজে প্রধান দেবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি পবিত্র স্থান বলে গণ্য করা হয়। গোন্ড সমাজে প্রাকবিবাহ যৌনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং ঘোটুলে অবস্থানকারী অবিবাহিত যুবক ও যুবতীদের মধ্যে যৌনসম্পর্কও স্বীকৃত। এদের সমজ মনোগ্যামাস অর্থাৎ একগামী হলেও বিবাহপূর্ব বহুগামীতার অনুমোদন রয়েছে। ঘোটুলে অবস্থান করার সময় অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলাদের একত্রে নাচ ও গান এর মাধ্যমে নিয়মানুবর্তীতা এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে শেখানো হয়। এদের সমাজে পুত্র সন্তানের জন্ম হলে তার মামা নাম রাখেন এবং কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তার পিসি সন্তানটির নাম রাখেন। যুবক বয়সে অবতীর্ণ হলে ছেলেরা দাড়ি, গোঁফ ও ভ্রু কামিয়ে এটি উদযাপন করেন। পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই ফসলের ক্ষেতের কাজ করতে হয়।

গোন্ড সমাজে মৃতদেহ সৎকার করার প্রথা প্রচলিত হলেও কোনো শিশুর মৃত্যু, অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যু অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহকে মাটির নীচে সমাধিস্থ করার প্রথা রয়েছে। গোন্ড সমাজ আত্মা এবং জীবনশক্তি অর্থাৎ লাইফ ফোর্স এ বিশ্বাস করে। এদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো মানুষের মৃত্যুর পর এই জীবনশক্তি অপর কোনো পার্থিব বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করে এবং আত্মা এই পৃথিবী ছেড়ে অপর একটি পৃথিবীতে অবস্থান করে। মানুষের মৃত্যুর পর তার অন্তিম কাজ ‘কারুণ’ নামে পরিচিত, যা অবশ্যই পালন করতে হয়। গোন্ড জনজাতি বর্তমানে বিলুপ্তির সম্মুখীন না হলেও এদের নিজস্ব ভাষা ‘গোন্ডি’ ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ‘ভালনারেবল’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Census of India-2011

Beine, D.K. 1994; A Sociolinguistic Survey of the Gondi-speaking Communities of Central India; San Diego State University

Bourah, D. M. Language Loss and Revitalization of Gondi Language: An Endangered Language of Central India. Languages in India

Gonds; Countries and their Cultures