পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

ঝাড়গ্রাম জেলা

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল পূর্বতন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাকে ভেঙে পৃথক ঝাড়গ্রাম জেলার সৃষ্টি হয়। এই জেলার উত্তরে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলা, পূর্ব ও পশ্চিমে যথাক্রমে কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা নদী। ঝাড়গ্রাম জেলার দক্ষিণপ্রান্তে ওড়িশা রাজ্য এবং পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড রাজ্য অবস্থিত। ঝাড়গ্রাম জেলা ছোটনাগপুর মালভূমির অংশবিশেষ, যা ক্রমশ পূর্বদিকে ঢালু হয়ে গেছে। ঝাড়গ্রাম জেলার মোট আয়তন ৩০৩৭ বর্গকিমি এবং জনঘনত্ব ৩৭০ জন/ বর্গকিমি। এই জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করেন; মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ তফশিলি জাতি এবং ২৯ শতাংশ তফশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
ঝাড়গ্রাম জেলার প্রধান সরকারি ভাষা বাংলা। তবে এখানকার বাংলা ভাষার রূপটি মান্য চলিত নয়, বাংলা ভাষার ঝাড়খণ্ডি প্রকারটির সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। ‘ও’ স্বরধ্বনির ‘অ’ তে রূপান্তর, ধ্বনিবিপর্যয় (কালি>কাইল, গালি>গাইল), নামধাতুর ব্যাপক ব্যবহার (মাথাটা দুখাচ্ছে), শ্বাসাঘাতের প্রবণতা ইত্যাদি এই রূপভেদটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে সাঁওতালি, মুণ্ডারি, কুর্মালি, ভূমিজ ও মাহালি ভাষার প্রচলন রয়েছে। ঝাড়গ্রাম জেলার মোট জনজাতি জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ সাঁওতালি ভাষা ব্যবহার করেন। ভূমিজ ও মুণ্ডা জনজাতির মধ্যে মুণ্ডারি ভাষার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া এই জেলার জনজাতির একটি বিশেষ অংশ কুর্মি সম্প্রদায় যারা কুর্মালি ভাষা ব্যবহার করেন। সাঁওতালি ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফশিলে স্বীকৃত অন্যতম আঞ্চলিক ভাষা, যা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠির উত্তর মুণ্ডা শাখার খেরওয়ারি উপশাখার অন্তর্গত। মুণ্ডারি ভাষাটিও সম উৎপত্তিস্তল থেকে আগত তবে সাঁওতালি ভাষার অলচিকি লিপির মতো এই ভাষারও নিজস্ব লিপি রয়েছে যা ‘মুণ্ডারি বাণী’ নামে পরিচিত। এই দুটি ভাষার শব্দভাণ্ডারের অনেকাংশে সাদৃশ্য রয়েছে। এছাড়া ঝাড়গ্রাম জেলায় বিনপুর ব্লকে মাহালি জনজাতির বসবাস রয়েছে। ডালটন এর মতে, সাঁওতালদের যে শাখাটি বাঁশের কাজে পারদর্শী হয়ে কালক্রমে সাঁওতালদের থেকে জীবিকার ভিত্তিতে পৃথক হয়ে যায়, তারাই মাহালি নামে পরিচিত। মাহালি ভাষা শাব্দিক ও ধ্বনিগত দিক থেকে মুণ্ডারি শাখার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও শব্দভাণ্ডারের প্রতি ঋনী। সামাজিক সম্পর্কসূচক শব্দগুলির সঙ্গে কিছু উপসর্গ ও অনুসর্গ জুড়ে তারা সামাজিক পদমার্যাদা, বয়স ইত্যাদি বিষয়গুলির সামঞ্জস্য রক্ষা করে। লিঙ্গগত বৈচিত্রের সূচক হিসেবে মাহালি ভাষায় ‘কোড়া’, ‘কুড়ি’, ‘গিদরা’ ইত্যাদি শব্দ প্রচলিত। প্রজন্মগত বৈসাদৃশ্যের ক্ষেত্রে ‘গারোম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মাহালি ভাষার সামাজিক সম্পর্কবাচক শব্দগুলি বক্তার লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয় না। এই ভাষার নিজস্ব লিপির অস্তিত্ব না থাকায় শিক্ষা ও সরকারি সুযোগসুবিধা লাভের জন্য মাহালিরা সাঁওতালি, কুর্মালি ও সাদরি ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী।
ঝাড়গ্রাম জেলার অপর উল্লেখযোগ্য জনজাতি হল কুর্মি-মাহাতো সম্প্রদায় যাদের ভাষা কুর্মালি। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের ভারতীয়-আর্য শাখার পূর্বী উপশাখার অন্তর্গত। এই ভাষা লেখার কাজে দেবনাগরী ও ‘চিস’ অথবা ‘কাইঠি’ লিপি ব্যবহৃত হয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে কুর্মালি ভাষা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। কুর্মালি ভাষা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশের জেলা (ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া) গুলিতে সেতু ভাষা অর্থাৎ লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, সাঁওতালি ইত্যাদি ভাষার সংস্পর্শে এসে কুর্মালি ভাষার নিজস্ব রূপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝাড়গ্রাম জেলায় বিভিন্ন জনজাতির বসবাসের ফলে করম পরব, টুসু পরব, ‘দিসুম সেন্দ্রা’ (শিকার উৎসব), এরখ সিম (যা ফসলের বীজ বোনার সময় সাঁওতালরা পালন করে) ইত্যাদি জনজাতির উৎসব, চুয়াং, চাং, ছৌ, ঝুমুর, রণপা ইতাদি লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটেছে।