অর্থনৈতিক দিক থেকে এই জনজাতি স্বনির্ভর এবং মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। এদের কৃষি ‘শিফটিং কালটিভেশন’ এবং ভেজা জমিতে চাষ অর্থাৎ ‘ওয়েট ল্যান্ড কাল্টিভেশন’ এই দুই প্রকারের হয়। এদের প্রধান খাদ্য ভাত, তাই এই জনজাতি ধান উৎপাদন করে। এছাড়া আলু, মিলেট জাতীয় শস্য, আখ ইত্যাদির চাষও এরা চাষ করে। শুকর, মুরগি, গরু, মহিষ ইত্যাদি পশু এরা গৃহে পালন করে এবং চাষের কাজে ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। বাঁশ, আখ, কাঠ প্রভৃতি বনজ সম্পদের জন্য এরা অরণ্যের উপর নির্ভরশীল। কোম জনজাতির মানুষ শিকারে পারদর্শী। তীর ও ধনুক সহযোগে বন থেকে পাখি ও অন্যান্য পশু শিকার করে এরা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এরা ‘ওয়াজু’ এবং ‘জুখা’ নামে ভাত থেকে তৈরি মদ পান করে।
কোম জনজাতির মানুষ মূলত মোঙ্গলয়েড শ্রেণিভুক্ত, ত্বক বাদামি বর্ণের, দেহ সুগঠিত। ব্রাউন এর মতে, কোম জনজাতির মানুষ প্রধানত মধ্য উচ্চতার হয়। এদের পোশাক দুই ভাগে বিভক্ত- নারীদের পোশাক ‘নুহমেইপন’ এবং পুরুষদের পোশাক ‘পাশেপন’ নামে পরিচিত। পুরুষরা ‘দের’ নামে একটি লম্বা, সরু তোয়ালেও ব্যবহার করে থাকে। এদের মধ্যে নিজস্ব প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গয়নার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে ‘খুটখি’ অর্থাৎ বালা, ‘বুংহার’ অর্থাৎ চুড়ি, ‘লুখুম’ অর্থাৎ মুকুট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পুরুষদের মধ্যে রুপোর কানের দুল পরার প্রচলন রয়েছে।
কোম জনজাতির কয়েকটি নিজস্ব উৎসব বর্তমান। এদের বীজ বপনের উৎসব ‘সেলিং’ নামে পরিচিত। এতে কাঠের একটি পোল এ বাঁধা গরুর উপর দিয়ে ছেলেদের ঝাঁপ দিতে হয়। যারা সাফল্য লাভ করে তাদের একটুকরো কাপড় দিয়ে সম্মান জানানো হয়। তারপর একটি গরু হত্যা করে চাষের মাঠে কাজ করা ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো হয়। ‘লুংফুন’ নামক উৎসবে কোনো মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে একটি সুবিশাল পাথর পোঁতা হয়। এখানে গ্রামের সকল পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ‘কুমথেই’ হলো পুরোনো মেইতেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছরে পালিত উৎসব। কোম জনজাতির সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় উৎসবটি হলো ‘লামকূট’। প্রায় এক মাস ধরে এই উৎসব পালন করা হয়। সন্ধেবেলা গান ও নাচ (লামকূট লাং) প্রত্যেক বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়, এবং প্রত্যেক বাড়িকে এই সময় পরিষ্কার করা হয়। জমিতে ফসল বোনার কাজ সম্পন্ন হলে ‘বেচাপ লাম’ নামক উৎসব পালিত হয়। এটি সাধারণত অগস্ট মাসে (ঝোংপুই) পালিত হয় এবং এটি সেপ্টেম্বর (করম) মাস অবধি চলে। কেবলমাত্র পূর্ণিমার রাতেই এই উৎসবটি পালন করা হয়। নভেম্বর মাসে ফসল কাটা হয়ে গেলে ‘কূট’ উৎসব পালিত হয়। মনে করা হয় যে, ফসল কাটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলে পরবর্তী বছরে আরো বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
কোম জনজাতির মধ্যে উত্তর-পূর্বের অন্য জনজাতির মতোই খ্রিস্টান ধর্ম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তবে অখ্রিস্টান কোমরা ‘পাথেন’ নামে প্রধান দেবতার উপাসনা করে। পাথেনকে এরা সমস্ত কিছু সৃষ্টির দেবতা বলে মনে করে। এরা মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে, মানুষের মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির আত্মা ‘খাটি খো’ নামে মৃতদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে যায়। এরা স্বর্গ ও মর্ত্যের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সুস্বাস্থ্য, ভালো ফসল এবং গ্রামের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির উদ্দেশ্যে পাথেন এর উপাসনা করা হয়। এদের গৃহদেবতা হিসেবে ‘ইন-লাই’ নামক দেবতার উপাসনা করা হয় এবং তার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ প্রজাতির মুরগি উৎসর্গ করা হয়। কোম জনজাতির পুরোহিতরা ‘থেম্পু’ বা ‘মাইপা’ নামে পরিচিত। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষে ‘খু-ইন্থোই’ নামক আচার পালন করা হয়। এটি পালন করার সময় সমস্ত গ্রামবাসীকে নিজের ঘরে থাকতে হয় এবং বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গ্রামের পুরুষেরা শিকারে যায় এবং যে ব্যক্তি কোনো শুকর বা অন্য কোনো পশু শিকার করতে সমর্থ হয় তার বাড়িতে ভোজের আয়োজন করা হয়। যদি কোনো শিকার না হয় তাহলে বন থেকে কোনো একটি পাখি শিকার করে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।
কোম জনজাতির বিবাহ মূলত পাত্র ও কন্যার বাবা-মায়ের দ্বারাই আয়োজিত হয়। এই জনজাতির মধ্যে কোনো পাত্র তার মামার মেয়েকে বিবাহ করতে পারে। একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ এবং একটি গোত্রের অন্তর্গত উপগোত্রগুলির মধ্যে বিবাহ কোম সমাজে নিষিদ্ধ। বিবাহের সময় পাত্রের বাড়ি থেকে কন্যাপণ দেওয়ার প্রথা রয়েছে। এছাড়া বিবাহের সময় পাত্রের বাড়ি থেকে কন্যার বাড়িতে উপহার হিসেবে ‘মিথুন’ নামক পশু উপহার হিসেবে পাঠানোর প্রথা রয়েছে।
শিশুর জন্মের পূর্বে গভাবস্থায় শিশুর মা কে কয়েকটি নিষেধ মেনে চলতে হয়। শিশুর মা কে সবসময় নিজের মাথা ঢেকে রেখে অনাগত শিশুকে সমস্ত দুষ্ট আত্মার হাত থেকে রক্ষা করতে হয়। এই প্রথাটি মূলত বাড়ির বাইরে বা জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন হলে অনুসরণ করা হয়। গর্ভস্থ শিশুর পিতা কোনো প্রাণী হত্যা করতে পারেন না। শিশুর জন্মের পর প্রথম পাঁচদিন শিশুর মা বাইরে যেতে পারেন না। জন্মের পাঁচদিন পর শিশুর নামকরণের উৎসব অর্থাৎ ‘নাইতেসো’ পালন করা হয় এবং নবজাত শিশুকে বাড়ির বাইরে আনা হয়। স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রত্যেক আত্মীয়কে খবর পাঠানো হয়, মৃতের আত্মা কাছেই রয়েছে এই বিশ্বাসে তারা ফুলের মালা ও পয়সা আনে। মৃতদেহকে সমাধিস্থ করাই কোম সমাজে প্রচলিত রীতি। তবে কোনো শিশুর মৃত্যু ঘটলে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মতো করে একই ভাবে সমাধি দেওয়া হয় না। নিকটবর্তী সমাধিক্ষেত্রে শিশুকে সমাহিত করা হয়, এবং এক্ষেত্রে কোনো আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় না। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্তিম অনুষ্ঠানটি স্বাভাবিক মৃত্যুর মতো করে পালিত হয় না। ঐ ব্যক্তির দেহ গ্রামের ভিতর আনা হয় না, সরাসরি সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে গিয়ে সমাধি দেওয়া হয়।
এই জনজাতির মধ্যে বর্তমানে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে বিচার করলে কোম জনজাতির কোনো ঘনসন্নিবিষ্ট বসতি না থাকার হলে এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নেপালি, হিন্দি, বাংলা, লেপচা তামাং ইত্যাদি সরকারি ও আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব বেশি হওয়ার কারণে এই ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি বিমিশ্রণ ও অবনমনের শিকার হচ্ছে।
Census of India- 2011
Devi, Ch. Sarajubala. 2011. Linguistic Ecology of Kom; In Singh, S.K. (ed.) Linguistic Ecology of Manipur. Guwahati: EBH Publishers.
Kom, K.T. 2009 A DESCRIPTION OF THE KOM SPEECH WITH SPECIAL EMPHASIS ON VARIATION, The Department of Linguistics, NEHU.
Singh, C.Y. 1995; The Lingmuistic Situation in Manipur; Linguistics of the Tibeto-Burman Area.