ওঁরাও জনজাতির মূল জীবিকা কৃষি ও উত্তরবঙ্গের চা বাগান কেন্দ্রিক। এদের নিজেদের জমির পরিমাণ খুব অল্প; মূলত ধানই প্রধান ফসল। পূর্বে খাদ্যসংগ্রাহক ও শিকারি জীবন যাপন করলেও প্রচলিত পদ্ধতিতে কৃষিকাজ এবং ফসলের বিনিময়ে অন্যের জমিতে মজুর হিসেবেও এদের কাজ করতে দেখা যায়। আগে এদের ঘরবাড়ি মূলত কলা ও সুপারি পাতা দিয়ে, মেঝে কাদা দিয়ে এবং ঘরের চাল ধান এবং গম গাছের আগড় দিয়ে তৈরি হতো। বর্তমানে মেঝে কাদা দিয়ে নির্মাণ করার রীতিটি প্রচলিত হলেও কলা এবং সুপারি পাতার পরিবর্তে বাঁশ এবং টিন ব্যবহার করা হয়।
হান (১৯৮৬) এর মতে, ‘ওঁরাও’ নামটি জনজাতির নিজস্ব শব্দ নয়। রায় (২০০৪) এর মতে, ‘উরাওন’ শব্দের মাধ্যমে পাশাপাশি বসবাসকারী হিন্দুরা এই জনজাতির মানুষকে চিহ্নিত করতেন। ওঁরাও জনজাতির মানুষ নিজেদের ‘কুরুখ’ বা ‘কুরুক্স’ হিসেবে পরিচয় দেয়। ওঁরাও সমাজের নিজস্ব গ্রামীণ সংগঠন ‘পদ্য পাঁচ’ নামে পরিচিত। ‘পাঁচ’ শব্দটি থাকলেও এই সংগঠনে ওঁরাও সমাজের যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষই সদস্য হিসেবে গণ্য হয়। ওঁরাও সমাজের সূর্য দেবতা ‘ধার্মেস’ এর পরেই এই সংগঠনের গুরুত্ব সর্বাধিক। এই সংগঠনটি গ্রামের মধ্যকার শৃঙ্খলা এবং অনুশাসন বজায় রাখতে কাজ করে। এছাড়া সম্পত্তি ও বিবাহ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানেও ওঁরাওদের নিজস্ব এই সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কয়েকটি গ্রামের ‘পদ্য পাঁচ’ সংগঠনের সমন্বয়ে ‘পারহা পঞ্চায়েত’ নামে একটি বৃহত্তর সংগঠন গঠিত হয় যা সাত, নয়, কুড়ি বা ত্রিশটি গ্রামকে নিয়ে গঠিত হতে পারে। ‘পারহা পঞ্চায়েত’ এর মাধ্যমে ক্ষুদ্রতর সংগঠনগুলির মধ্যে একটি সুসংহত বিন্যাস বজায় রাখা হয়।
শেষ অনুষ্ঠান পালন করে। এছাড়া ‘পাল কানস্না’, ‘ভেলওয়া ফাড়ি’, ‘ভাগ বুড়া’ ইত্যাদি অনুষ্ঠানও ওঁরাও জনজাতির পালিত উৎসব। দণ্ড বা ডাণ্ডা এর ব্যবহার ওঁরাও জনজাতির অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ দিক। এদের উপাসনার জন্য সারনা নামে একটি বিশেষ পবিত্র স্থান ব্যবহৃত হয়। একটি বিশেষ বিশেষ গাছের নীচে মোরগ বলির মাধ্যমে এরা দেবতাকে নিবেদন করে। তাই ওঁরাওদের ধর্মকে কোনভাবেই ‘সারনা’ বলা যায় না, যেহেতু এটি উপাসনার স্থান।
ওঁরাও সমাজ ৬৮টি টোটেমিক গোত্রে বিভক্ত যার মধ্যে ৪৩টি প্রাণী, ১৯টি উদ্ভিদ, ২টি খনিজ, ২টি স্থানের নামে পরিচিত। টোটেমগুলিকে ওঁরাও সমাজে পবিত্র বলে গণ্য করা হয় এবং তারা কোনো টোটেমকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না অথবা কোনোভাবে ক্ষতি করে না। গোত্রগুলির মধ্যে কোন উচ্চ-নীচ ভাগ নেই। ওঁরাও সমাজ পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার ফলে পিতার গোত্র পরিচয় পুত্রে স্থানান্তরিত হয়। ওঁরাওদের মধ্যে যৌথ পরিবার প্রথার প্রচলন নেই, পুরুষরাই পরিবারের প্রধান হিসেবে গণ্য হন। ওঁরাও সমাজে জমির উপর উত্তরাধিকার সূত্রে মেয়েদের কোন অধিকার স্বীকৃত নয়। পিতার মৃত্যুর পর তার মালিকানায় থাকা জমি জীবিত পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। বিবাহের পর মহিলাদের গোত্র পরিবর্তিত হয়ে তারা স্বামীর গোত্রভুক্ত হন। যদি কারো সন্তান না থাকে তাহলে মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ভাইপো অর্থাৎ দাদা বা ভাইয়ের ছেলের মালিকানাভুক্ত হয়।
ওঁরাও সমাজে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পুরুষ ও মহিলার বিবাহ স্বীকৃত, বাল্যবিবাহ স্বীকৃত নয়। মূলত পিতা বা পরিবারের প্রধান বিয়ের আয়োজন করেন, খরচ পরিবার নির্বাহ করে এবং আত্মীয় ও সমাজের অন্যান্যরা মাংস, হাড়িয়া অর্থাৎ দেশি মদ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সরবরাহ করে। বিবাহে ‘করসবন্দ’ নামে এক বিশেষ চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, এদের বিবাহে পুরোহিত বা কোন ধর্মীয় গুরু উপস্থিত থাকেন না। সমগোত্রে বিবাহ ওঁরাও সমাজে স্বীকৃত নয়। বর্তমানে বেশিরভাগ ওঁরাও জনজাতির মানুষ মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হলেও বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এরা নিজেদের জনজাতির প্রাচীন ও নিজস্ব প্রথাগুলিই অনুসরণ করে থাকে। এদের নিজস্ব পোশাক নেংটি (পুরুষ) এবং ফোটা (মহিলা) নামে পরিচিত।
কুরুখ ভাষা বর্তমানে স্বীকৃত সরকারি ভাষা হওয়ার সত্ত্বেও এবং এই ভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা স্বল্প না হলেও পার্শ্ববর্তী হিন্দি ও সাদরি ভাষার আধিপত্যের কারণে এটি ওঁরাও সমাজে একটি নন-ফ্লুয়েণ্ট প্রথম ভাষায় পরিণত হয়েছে, যার ফলে ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমশ অবলুপ্ত হচ্ছে।
Islam, Md. Rafiul. Culture, Economy and Identity: A Study of the Oraon Ethnic Community. College of Arts, Society and Education, James Cook University, Australia. 2014.
Census of India, 2011.
Hammarstrom, Harold; Forkel, Robert; Hapselmith, Martin, eds. (2017). “Kurux” Glottolog 3.0. Jena, Germany: Max Planc Institute for the Science of Human History.