পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

চোকরি সংস্কৃতি

বর্তমানে চাখেসাং জনজাতির মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এদের প্রধান পালিত উৎসবটি হলো ‘সুখুরুহুয়ে’, যেটি প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি পালন করা হয়। এই উৎসবটি ১১দিন ধরে পালন করা হয়, যার প্রথম দিনটি ‘নেয়েদে' অথবা ‘চেদু' নামে পরিচিত। এই উৎসবের দ্বিতীয় দিন ‘সুহ-ক্রুহ' নামে পরিচিত। এই কথাটির অর্থ হলো, আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোর ও যুবক বয়সীদের শুদ্ধিকরণ। এই উৎসবের সময় পশু বলি দিয়ে তার রক্ত দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। কেবলমাত্র পুরুষদের দ্বারা অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ প্রকার নৃত্য এই উৎসবের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই উৎসবে ব্যবহৃত বাসনপত্র, রান্নার কাজে ব্যবহৃত উনুন ইত্যাদি সমস্ত কিছুই পুরনোর পরিবর্তে নতুন ব্যবহার করতে হয়। উৎসবে পালিত সমস্ত রীতিনীতি ‘সুরুখ' নামে পরিচিত, এবং ‘হুয়ে’ শব্দের অর্থ হলো উৎসব।

এদের জীবন মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। জঙ্গলে শিকার এদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকার ‘রুহ উমি’ নামে পরিচিত। শিকারিরা এদের সমাজে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে আইন প্রণয়ন করে এই শিকারের প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদের সমাজে কোনো শিকারি বাঘ হত্যা করতে পারলে তার মাথায় একটি বন্ধনী দিয়ে সম্মান জানানোর প্রথা রয়েছে। এছাড়া কাঠ ও বাঁশের জিনিসপত্র তৈরিতেও চাখেসাং জনজাতির মানুষের দক্ষতা রয়েছে। সুতার কাজও এই জনজাতির মানুষের জীবিকা অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায়। পার্বত্য অঞ্চলের জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসের কারণে এখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কম। তাই পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে চাষ, ঝুমচাষ এবং বিশেষ পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদেও এরা চাষ করে থাকে। ভুট্টা ও সুপারি এদের প্রধান উৎপাদিত ফসল।

এই জনজাতির ব্যবহৃত ভাষাটির ফোনোলজি, মরফোলজি এবং সিনট্যাক্স সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণার অভাব রয়েছে। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক ভাষা অথবা একটি ডায়ালেক্ট- এই বিষয়টি সম্পর্কেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। এদের ভাষার লিখিত রূপ না থাকার কারণে কোনও প্রামাণ্য ব্যাকরণ তথা প্রাইমার রচনা করা সম্ভব হয়নি। ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করে এই ভাষার শব্দভাণ্ডারের সমস্ত শব্দগুলির যথাযথ ট্রান্সক্রিপশন করা সম্ভব হয়নি। এই ভাষার প্রামাণ্য অভিধান রচনার কাজও তেমনভাবে শুরু হয়নি। ফলে এই ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলির উৎস সম্পর্কেও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।

এছাড়া এদের দ্বিভাষিক প্রবণতার কারণে ‘কোড-সুইচিং’ এবং ‘কোড-মিক্সিং’ এর প্রবণতার ফলেও ভাষাটিতে অন্য ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, নাগাল্যাণ্ড ও মণিপুর- এই চার রাজ্যের কোনোটিতেই ভাষাটি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। ফলে স্কুলের পাঠক্রমেও ভাষাটি স্থান করে নিতে পারেনি। এই জনজাতির মানুষ বাড়িতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার সময়ও অনেকক্ষেত্রে আঙ্গামী ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তাই এই জনজাতির শিশুরা বাড়ির পরিবেশে মাতৃভাষা হিসেবে চোকরি ভাষা শেখার সুযোগ পায় না। ভাষাটি পূর্ব প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঠিকভাবে সঞ্চারিত না হওয়ায় এদের ভাষাবৈশিষ্ট্য এবং প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে তরুণদের মধ্যে কোনো সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এই সমস্ত কারণে চোকরি ভাষার ব্যবহার ক্রমশ কমছে। পশিমবঙ্গ, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশে এদের ঘনসন্নিবিষ্ট জনবসতির অভাবে এদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহও ক্রমশ বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। পারিবারিক পর্যায়ে ভাষাটির কম ব্যবহারের প্রবণতার কারণে ইউনেস্কোর দ্বারা প্রকাশিত ভারতের বিপন্ন ভাষার তালিকায় চোকরি ভাষা ‘ভালনারেবল' শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Bielenberg, B. & Zhalie, N. 2001. Chokri (Phek Dialect): Phonetics and Phonology; Linguistics of the Tibeto-Burman Area.

Census of India- 2011

Chokri, www.ethnologue.com