রাভা জনজাতি মূলত জঙ্গলবাসী, সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। ৫০ থেকে ১০০টি পরিবার গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে এক-একটি বসতি গড়ে তোলে। এই জনজাতির একটি বিশেষ গৃহশৈলী রয়েছে। একটি বাড়ি চারভাগে বিভক্ত। উঠোনের উত্তরদিকের অংশে পরিবারের প্রধান বসবাস করেন। এটি ‘নক্সরাব’ নামে পরিচিত। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাসস্থানটি ‘তগরাব’ নামে পরিচিত এবং এই অংশের মুখোমুখি থাকে ‘ভাটঘর’ অর্থাৎ অতিথিশালা। রান্নাঘরটি ‘রোসিনক’ নামে পরিচিত। অপরদুটি অংশও উঠোনে পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করে। কৃষিই এদের প্রধান জীবিকা- মূলত আলু, শালিধান, সুপারি, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ করে এদের জীবিকা নির্বাহ হয়। তবে জঙ্গলের অধিবাসী হওয়ায় জলসেচের সুবিধা না থাকায় সারাবছর ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। কৃষিকাজ মূলত বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। তবে চাষযোগ্য জমির অপ্রতুলতার কারণে রাভাদের দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেও দেখা যায়। পশুপালনও এই উপজাতির জীবিকা অর্জনের অপর একটি প্রধান উপায়। প্রধানত গবাদিপশু, শুকর ইত্যাদি এরা প্রতিপালন করে। ভাত, মাছ, শুকরের মাংস ও ভাত থেকে তৈরী মদ এদের প্রধান খাদ্য। এদের অর্থনীতি বনজ সম্পদের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। এরা চিরাচরিত চাষ পদ্ধতির পরিবর্তে পাহাড়ি এলাকায় প্রচলিত স্থানান্তর কৃষিতেই অভ্যস্ত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে জঙ্গলের উপর এদের স্বাভাবিক অধিকার অনেকাংশে হরণ করা হয়, এরা স্বভাবত সরল ও মৃদুভাষী হওয়ায় বিনা প্রতিরোধে এরা লাঙল ও কোদাল সহযোগে প্রচলিত চাষপদ্ধতিই অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। শিকারের ঐতিহ্যও বর্তমানে বন্যপ্রাণী আইনের কড়াকড়ির ফলে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। রাভা জনজাতির স্ত্রীলোকরা সুতোর কাজে দক্ষ। স্ত্রীলোকরা নিজেদের ও সম্প্রদায়ের পুরুষদের পোষাক নিজেরা তৈরি করে। মেয়েদের পোষাকের অন্তর্গত হলো রিফাং, কামবুং এবং খোদাবাং- যেগুলি বিবাহের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। পুরুষদের পোষাকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পাজাল, খানসে, ফালি ইত্যাদি। এর মধ্যে পাজাল পোষাকটি এড়ি রেশম দিয়ে তৈরী করা হয়। সুতোর কাজ রাভা স্ত্রীলোকদের বিবাহ ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
রাভাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হওয়ায় মাতৃবংশের উত্তরাধিকার এখানে স্বীকৃত। এই সমাজে ‘মাহারী’ (Mahari) প্রথা প্রচলিত আছে, যে প্রথা অনুসারে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর মেয়েদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার অর্পণ করা হয়। মাহারী বলতে একটি বিবাহসম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মহিলাদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠনকে বোঝায়- যা হৌসাগ (Housug) নামেও পরিচিত। স্ত্রীর মৃত্যু অথবা সন্তানহীনতাজনিত কারণে কোন পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহের প্রয়োজন হলে মাহারীর সকল সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এই প্রকার বিবাহ ‘নক ধানকায়’ (Nok Dhankay) নামে পরিচিত যার অর্থ হলো, এই বিবাহে সংশ্লিষ্ট পুরুষটি অর্থাৎ বরকে অবশ্যই কন্যার পিতার বাড়িতে সারাজীবনের জন্য অবস্থান করতে হবে এবং উক্ত পুরুষ আর কখনও নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন না। যদিও বর্তমান সময়ে রাভা সমাজে পুরনো প্রথাগুলির অবসান ঘটছে এবং এখনকার রাভা সমাজ পিতৃতান্ত্রিকতা ও মাতৃতান্ত্রিকতার মধ্যবর্তী একটি স্তরে অবস্থান করে।
রাভা সমাজ মূলত ৩টি গোত্রে বিভক্ত, যাদের একএকটি ‘বার’ বা ‘বারই’ বলা হয়য়। দুটি ‘বারই’ এর অন্তর্ভুক্ত স্ত্রী ও পুরুষ পরস্পর বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারী হলেও একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত পুরুষ ও মহিলার বিবাহ রাভা সমাজে অনুমোদিত নয়। তিনটি প্রধান গোত্র হলো যথাক্রমে- চুরচুং (churchung), হাটো (hato) ও রাইদুং (raidung)। রাভা সমাজ স্থানীয় শাসন আইন অথবা পাণ্ডুলিপি (pandulipi) এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা রীতি পদ্ধতি ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে গ্রামের মানুষের ঐক্যমতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই আইনগুলি সাধারণত শাসনপদ্ধতি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, শিশুর জন্ম সংক্রান্ত বিধি ও মানুষের মৃত্যু পরবর্তী পালনীয় কর্তব্যগুলি নির্দেশ করে। রাভা জনজাতির মানুষ সাধারণত সরল; এবং তারা নিজেদের গারোদের থেকে উচ্চশ্রেণির বলে মনে করে।
রাভা জনজাতির বিবাহ পুরোহিতের ঠিক করা একটি নির্দিষ্ট শুভদিনে সম্পন্ন হয়। কতকগুলি নির্দিষ্ট ধাপে বিবাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়- পান-তামুল কাটা, গোটা তামুল খাওয়া, পান-চিনি ইত্যাদি। রাভা জনজাতির স্ত্রীলোকরা শিশুর জন্মের সময় গর্ভযন্ত্রণা উপশমের জন্য বাই-মা-বা নামে এক দেবীর উপাসনা করে থাকে।
রাভা জনজাতি স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃতদেহকে শান্তিজলে ধুইয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে পরদিন সকালে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করে। মৃতদেহ সমাধিস্থ না হওয়া পর্যন্ত সমগ্র গ্রামের অধিবাসীরা কেউই খাদ্যগ্রহণ করে না। একটি নির্দিষ্ট দিনে মৃতের উদ্দেশ্যে মায়সেক (maysek)- সেদ্ধ ভাত, মাছ, মাংস , ডিম ও মদ উৎসর্গ করা হয়।
রাভা জনজাতির মানুষ তাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে প্রকৃতি ও জীবজন্তুর উপাসনায় বিশ্বাসী। তাদের উপাস্য প্রতিটি দেবতার চিহ্নক ছিল একএকটি পাথর, যথা- লাঙ্গা, খোসকী, ঠাকুরাণী ইত্যাদি। বর্তমানে রাভাদের মধ্যে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্ম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে রাভাদের মধ্যে মূর্তিপূজার প্রবণতাও বাড়ছে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে রাভাদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষারও প্রসার ঘটেছে। রাভা গ্রামগুলিতে চার্চ গড়ে উঠেছে। রাভাদের নিজস্ব প্রাচীন সংস্কৃতিতে বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন- বাদুংদুপ্পা, গোমোনে, কাড়া, সিংগা ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে রাভা ভাষায় একাধিক নাটক ও সংগীত এলবাম তৈরী হয়েছে। বৈশাখ মাসে নদীর ধারে লাংগাপূজার (যেখানে মহাদেব প্রধান উপাস্য দেবতা) প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বাইখো, হাচংপূজা ইত্যাদি রাভা জনজাতির নিজস্ব উৎসব। অন্যান্য ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে রাভা জনজাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টগুলি বিলুপ্তির সম্মুখীন হচ্ছে। ‘ফারক্রান্তি’- রাভা জনজাতির মানুষের মৃত্যুর পর যে পালনীয় আচার-অনুষ্ঠান অতীতে বিস্তারিতভাবে পালন করা হতো, বর্তমানে সেই ঐতিহ্য লুপ্তপ্রায়।
রাভা জনজাতির পরিপার্শ্বস্থ অঞ্চলে বাংলা ও অসমিয়া জাতি ও ভাষার মানুষের বাস। এই দুটিই যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ ও অসম রাজ্যের রাজ্য-সরকারি ভাষা হওয়ায় এবং রাভা ভাষায় স্কুল-কলেজের পাঠক্রম গড়ে না ওঠার ফলে রাভা জনজাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি ভাষাটিও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় রাভা ভাষাকে ‘ভালনারেবল’ (vulnerable) শ্রেনিভুক্ত করা হয়েছে। ‘বেবাক রাভা ক্রোড়াং রংচমাম’ (Bebak Rabha Krowrang Rongchmum) নামে সংগঠন সর্বপ্রথম রাভা ভাষার মান্যরূপ প্রবর্তনের চেষ্টা করে। রাভা ভাষা পরিষদের (অসম) চেষ্টায় রংদানি উপভাষায় প্রাইমার ও ব্যাকরণ রচিত হয়। নিজস্ব লিপির অভাবে বইগুলিতে বাংলা-অসমিয়া লিপিই ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে রাভা ভাষায় ‘মার্কনি নিমা সাইকাই’ (Markni Nima Saikai) নামে বাইবেল অনুদিত হয়। এসমস্ত উদ্যোগ সত্ত্বেও বর্তমানে রাভা জনজাতির শিশুদের মধ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও কাজের সুযোগের অভাবজনিত কারণে নিজ মাতৃভাষা শিক্ষায় আগ্রহের অভাব, লিপির অনুপুস্থিতির কারণে লিখিত সাহিত্যের অপ্রাচুর্য ইত্যাদি কারণে রাভা জনজাতির নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যের অবনমন ও বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
Grierson, G.A. Linguistic Survey of India Vol 3, Part 1. Motilal Banarasidas, 1967.
Hale, Austin. Research on Tibeto-Burman Language. Mouton Publishers, 1982.
Pereira, The Rabhas in Census of Assam, 2011.
Census of India-2001.
Joseph, U.V. RABHA BRILL, 2007.