ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের রাজমহল পর্বতের অধিবাসী অন্যান্য জনজাতির মতোই মালতো জনজাতিও নোমাডিক, খাদ্য-সংগ্রাহক জীবন জাপন করতো। ব্রিটিশরা যখন সর্বপ্রথম এদের মুখোমুখি হয়, তখন এই জনজাতি জঙ্গল নির্ভর জীবনে বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও স্বীকার ছাড়াও পাহাড়ের ঢালে ঝুমচাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। ঝুমচাষ মালতো ভাষায় ‘কুরওয়া’ নামে পরিচিত। কোনো বছর কোনো কারণে খরা বা দুর্ভিক্ষ হলে সেই স্থান ছেড়ে অন্য উপযুক্ত স্থানে বসতি স্থাপন করতো, অর্থাৎ এরা ছিল যাযাবর, পরিযানের কারণে এদের কোনো স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা এই রাজমহল পর্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহিরাগত সাঁওতালদের কৃষির শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসে; ফলে এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা মালতো জনজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মালতো জনজাতির তিনটি শাখা অর্থাৎ মাল-পাহাড়িয়া, কুমারভাগ পাহাড়িয়া ও সৌরিয়া-পাহাড়িয়াদের মধ্যে আন্তর্বিবাহের প্রচলন নেই। গোমাংস ভক্ষণ প্রচলিত থাকায় মাল-পাহাড়িয়া শাখাটি সৌরিয়া পাহাড়িয়াদের অন্ত্যজ অর্থাৎ নিচু বলে মনে করে। মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃতব্যাক্তির আত্মার শান্তিকামনায় মৃত্যুর ছয়দিন পর তার পারলৌকিক কাজ করা হয়, এবং মৃতব্যাক্তির উদ্দেশ্যে চাল, ডাল, তেল, দেশি মোরগ, শুকর ইত্যাদির মাংস নিবেদন করা হয়। মালতো জনজাতি অ্যানিমিজম অভ্যাস করে। এদের দেবতারা ‘গোঁসাই’ নামে পরিচিত। মালতো জনজাতির প্রধান দেবতা ‘ধার্মের গোঁসাই’ নামে পরিচিত, যিনি হলেন সূর্যদেবতা। এছাড়া মালতো জনজাতির গ্রামদেবতারা ‘মাইত’, ‘মা’, ‘গাঙ্গাদি’, ‘সুনাদি’, ‘রূপাদি’, ‘বুধরাজা’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। মালতো জনজাতির পুরোহিতরা ‘দেমানো’ নামে পরিচিত। এই জনজাতির পুরুষদের পোষাক ‘ভাগওয়ান’ নামে পরিচিত, এটি একটি ছোট ও সুতোর তৈরি পোষাক। অপরদিক মহিলাদের পরিধেয় পোষাক দুই ভাগে বিভক্ত; উপরের অংশ ‘পঞ্চি’ এবং নিচের অংশ ‘পারধান’ নামে পরিচিত, যেটি কোমর থেকে দেহের নিম্নভাগ আবৃত রাখে।
সৌরিয়া-পাহাড়িয়া শাখার প্রথাগত বিবাহ ‘বেদি’ নামে পরিচিত। এই জনজাতির মধ্যে প্রি-ম্যারিটাল সেক্স অর্থাৎ প্রাকবিবাহ যৌনতা সম্পর্কে কোনো ট্যাবু বা নিষেধের অস্তিত্ব নেই। এই যৌনতার ফসল হিসেবে যে শিশুর জন্ম হয়, সে মায়ের সাথেই বসবাসের অধিকারী হয়। এই জনজাতির মধ্যে কন্যাকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে বিবাহের প্রথাও প্রচলিত। কুমারভাগ পাহাড়িয়াদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুণর্বিবাহের প্রথাও প্রচলিত। এই জনজাতির মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিবাহের প্রথা এখনও বর্তমান। বর্তমানে এরা খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের অনুসারী হওয়ার ফলে এদের প্রাচীন বিবাহপ্রথা ‘বেদী’ ছাড়াও খ্রিস্টান এবং হিন্দু ধর্মের আচার অনু্যায়ীও বর্তমানে বিবাহ হয়। সাধারণত পুরুষ ও মহিলার ক্ষেত্রে সমাজ অনুমোদিত বিবাহের বয়স যথাক্রমে ১৯-২৩ বছর এবং ১৪-১৮ বছর। অল্প বয়সে বিবাহ হওয়ায় এই জনজাতির পরিবারের আয়তন সাধারণত বড়ো হয়; অনেকসময় একটি দম্পতির ৫-৬টি সন্তানও থাকতে দেখা যায়।
শিশুর জন্ম মালতো সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্তসত্ত্বা মহিলাদের খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত মিষ্টি বা টকজাতীয় খাদ্য নিষিদ্ধ থাকে। এছাড়া এই মহিলাদের রাতে বাড়ি থেকে বেরোনোও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শিশুর জন্মের পর একজন ‘ধাই-মা’ শিশুকে পরিষ্কার করেন। জন্মের ৬ দিন পর শিশুর নামকরণ করা হয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকার পরিবারের প্রথম অর্থাৎ বড়ো পুত্রের উপর অর্পিত হয়।
মালতো জনজাতির বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ মৃত্যুর পর কর্ম অনুযায়ী উপকারী বা অপকারী আত্মায় রূপান্তরিত হয়। অপমৃত্যুর পর সাধারণত মৃত ব্যক্তির আত্মা অপকারী আত্মায় পরিণত হয়ে নিকটাত্মীয়দের ক্ষতি করার চেষ্টা করে বলে মালতো সমাজ বিশ্বাস করে। তবে আধুনিকতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই সুপ্রাচীন বিশ্বাস ও ঐতিহ্যগুলি আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হচ্ছে। মালতো জনজাতির নিজস্ব ভাষার কোনো সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় এবং এই ভাষা স্কুলের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার ফলে এই ভাষাটির সংরক্ষণও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ভাষাটি ‘ডেফিনিটলি এন্ডেঞ্জারড’ শ্রেণিতে স্থান পেয়েছে।
Census of India-2011
Droese, Ernest. 1884 Introduction to the Malto Language; Oxford University.
Manna, Samita; & Ghosh, Anita; 2016 Souria Paharia are now in Transition: Beliefs, Rituals and Practices. Research Gate
Puttaswami, C. 2009 Structure of Verbs in Malto; JSAL Vol. 2, issue 1