পশ্চিমবঙ্গের ভাষাবৈচিত্র্য ড্যাশবোর্ড

ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ

তথ্যপ্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন বিভাগ

মেচ সংস্কৃতি

মেচ জনজাতির মানুষ মূলত কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। তারা ঝুম চাষ প্রথার মাধ্যমে জঙ্গল কেটে ও পুড়িয়ে বীজ রোপণ করে চাষ করত। তারা লাঙল ও হালের ব্যবহার জানত না। মূলত কটন (রেশম) ছিল তাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। বৃটিশ আমলে চা বাগানের সম্প্রসারণের জন্য তাদের জঙ্গলের উপর অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের জঙ্গল থেকে উৎখাত করা হয়। তারা ঝুম চাষ ত্যাগ করে প্রচলিত প্রথায় কৃষিকাজ করতে শুরু করে এবং ধানচাষে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া সুপারি চাষের মাধ্যমেও তাদের অর্থাগম ঘটে। মেচ জনজাতির নারীরা এখনো মূলত এড়ি রেশম মথ প্রতিপালন করে। বাঁশের তৈরি এক বিশেষ প্রাচীন তাঁত বোনার যন্ত্র ‘কান্তি’র মাধমে তারা তাঁত বোনে। বাঁশের ঝুড়ি, মাছ ধরার জাল ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে থাকে। বর্তমানে মেচ জনজাতি ধান চাষেও অভ্যস্ত। তারা দিনে তিনবার ভাত খায়- সকালের ভাত ‘খাম-গো-যাঙ’, দুপুরের ভাত ‘সানযা-ফু’ এবং সন্ধের ভাত ‘বি-নি-মি-খাম’ নামে পরিচিত। মেচ জাতির মধ্যে শুকরের মাংস (ওমা বিদর), মুরগির মাংস (দৌ বিদর), হাঁসের মাংস (হাংসা বিদর), পায়রার মাংস (ফারাউ বিদর) ইত্যাদি খাদ্য প্রচলিত।

ঐতিহ্যগতভাবে মেচ জনজাতির মানুষ বাঁশের তৈরি বাড়িতে বসবাস করে। সমগ্র বাড়িটি কয়েকটি কুঁড়েঘর এর সমন্বয়ে গঠিত। উত্তরদিকের কুঁড়েঘরটি আকারে অপেক্ষাকৃত বড়ো হয় যেখানে ধনসম্পদের দেবতা ‘মাইনৌ’ বসবাস করেন। মেচ ভাষায় বাড়িকে ‘না’ বলা হয়। প্রধানত খড় ও জঙ্গলের ঘাস দিয়ে কুঁড়েঘর তৈরি হয়। রান্নাঘর ও শোয়ার ঘর আলাদা হয়। প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে কুয়া বর্তমান। বাড়িগুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়; প্রত্যেক বাড়িতে বেশকিছু মশলার গাছ লাগানো হয়। বর্তমানে অবস্থাপন্ন মেচরা কাঠের বাড়িতে বসবাস করেন। বাড়িতে বাঁশের তৈরি খাট (মাচাঙ) থাকে; বাসনপত্রগুলি প্রধানত লোহা ও এলুমিনিয়ামের তৈরি হয়। এছাড়া মাটির তৈরি কুঁজো (হাচুঙ), মাটির অথবা কাঠের তৈরি পাত্র (থুরসি), ঝাঁটা (হাসিব), পাট ও রেশমের তৈরি বালিশ (গাণ্ডু) মেচ জনজাতির মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

মেচ শিশুদের পোশাক হল ‘নাঙটি’, যা মেয়েরা বোনে। দশ-বারো বছর বয়সে এবং যুবক ও বৃদ্ধদের মধ্যে ‘গামছা’ পরার চল রয়েছে। শীতকালে ব্যবহৃত চাদরটিকে ‘মদম্নি গামছা’ বলা হয়, যা এড়ি রেশম দিয়ে বাড়িতে তৈরি হয়। মেচ মহিলাদের পোশাক প্রধানত হলুদ রঙের হয়; মেয়েদের পোশাক ‘দাখনা থিন্থাই’ অথবা ‘দোখনা আশার’ নামে পরিচিত। মেচদের মধ্যে রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাশের তৈরি ছাতা ‘ঘুম’ ব্যবহারের চল রয়েছে। এর কোনো হাতল নেই, এটি মাথায় পরে নেওয়া হয়।

মেচরা মূলত যৌথ পরিবার প্রথায় বিশ্বাসী; বিয়ের পর ছেলেরা পৃথক বাড়িতে থাকার প্রথা নেই। মেয়েরা সাধারণত বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে থাকে। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তান সম্পত্তির অধিকার লাভ করে। বিবাহিত বা অবিবাহিত- কোনো কন্যারই সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার মেচ সমাজে স্বীকৃত নয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকার , বিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য মেচ সমাজে অন্যান্য উপজাতির মতোই একটি পিতৃস্থানীয় সংগঠন রয়েছে যা বিভিন্ন ‘আরি’ সহযোগে গঠিত। এদের বলা হয় ‘ফরইহোল’। মেচ সমাজে উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের কোন ভেদাভেদ নেই। মেচদের মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত না থাকলেও শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুশাসনগুলিও উঠে যাচ্ছে।

শিশুবিবাহ ও বহুবিবাহ মেচ সমাজে দেখা যায় না। পূর্বে বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাপণ প্রথা থাকলেও বর্তমানে বরপণ প্রথা প্রচলিত। সাধারণত ছেলে বা মেয়ে বয়স্থ হলে ঘটক অর্থাৎ ‘গাডোয়া’ এর মাধ্যমে সম্বন্ধ ঠিক করা হয়। ‘গাডোয়া’ অর্থাৎ ঘটক প্রথমে কন্যার বাড়িতে কথা বলে একটি তারিখ নির্দিষ্ট করে; সেই তারিখে পুত্রের অভিভাবকরা পানপাতা, সুপারি ও কিছু নগদ টাকা সহযোগে সিজু গাছের নীচে একটি বিশেষ পূজা করে কন্যার বাড়ি যায়। যদি কন্যাপক্ষ অরাজি হয় তাহলে জিনিসগুলি ফেরত আনা হয়। রাজি হলে কন্যার বাড়িতে বারবার উপরোক্ত জিনিসগুলি পাঠানো হতে থাকে। দুই পরিবার একসাথে বসে বিবাহ ঠিক করে যাকে ‘গোইগাওনা’ বলা হয়। মেচ সমাজে বছরের কোন মাসেই বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। বাথৌ দেবতার উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়।

মেচ সমাজে মানুষ মারা গেলে তাকে ভূমিতে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধ দেওয়ার পর প্রত্যেকে একমুঠো মাটি দেয়। মানুষের মৃত্যুর পর ১১ দিন অশৌচ পালনের পর ‘আফছগার নাই’ অর্থাৎ অন্তিম কাজ ও শুদ্ধিকরণ সম্পন্ন হয়। যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে মৃতের উদ্দেশ্যে মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয় তাকে ‘মাছোগারনোরি’ এবং যেখানে শাকসবজি উৎসর্গ করা হয় তাকে ‘বাঙ্গারনাই’ বলা হয়।

মেচ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রকৃতির পূজারী; অলৌকিক ক্ষমতাযুক্ত যেকোন ব্যক্তি বা বস্তুকেই এরা দেবতা হিসেবে উপাসনা করে। মেচ জনজাতির প্রধান দেবতা হলেন ‘বাথৌ’ যার প্রতীক হল একটি বিশেষ গাছ যা প্রতিটি বাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে লাগানো থাকে। মেচদের প্রধান দেবী হলেন মাইনৌ যার অবস্থান রান্নাঘরে। প্রতি বৈশাখ মাসে বাথৌ এর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মাইনৌ হলেন শস্যের দেবী; বিবাহ, অন্নপ্রাশন, নবান্ন ইত্যাদি উৎসবের সময় এর উপাসনা করা হয়। এছাড়া সরিস দেবদেবী, বিষহরি ও মহেশ ঠাকুরের পূজা প্রচলিত। পারিবারিক ও সামাজিক পূজাগুলি পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয়। মেচ সমাজের সবচেয়ে বড়ো উৎসব হল ‘কেরান পূজা’। এটি তিন প্রকার-আই কেরান, মাদল কেরান ও গারজা কেরান। তৃতীয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ কয়েকটি গ্রাম সম্মিলিতভাবে এর আয়োজন করে থাকে। এছাড়া বছরের প্রথম দিনে মেচরা ‘বাইসাগু’ নামক উৎসব পালন করে। এছাড়া জঙ্গলের দেবতা ‘হারগা মোদোই’ এর পূজা মেচ সমাজে প্রচলিত। পূজা করার জন্য মেচ সমাজে যে পারিবারিক পুরোহিত থাকেন তাঁকে ‘রোসা বলা হয়। প্রত্যেক পূজার আবশ্যিক উপকরণ হল ‘জৌ’ বা মদ। মেচ সম্প্রদায়ের যেসমস্ত মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত, তাঁরা এই প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি পালন করেন না।

মেচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র বর্তমান, যেমন- সিফুং, খাম, খামোয়াং, সেরজা, যোথা, থারখা ইত্যাদি, যেগুলি মূলত বাঁশের তৈরি। মেচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব নাচ ‘মোসানাই’ নামে পরিচিত। এই জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্যগুলি হল খেরাই নাচ, বাগুরুম্বা নাচ ও বাইসাগু-মেথায়। বিবাহ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিকার ইত্যাদির সময় এই নাচগুলি অনুষ্ঠিত হয়। নাচের সময় খাম, সিফুং ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রগুলি সঙ্গত করতে ব্যবহার করা হয়। বাগুরুম্বা নাচ মূলত মেয়েরা বসন্তকালে নাচে; প্রকৃতির উপাসনায় এই নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম তিনদিন প্রধান দেবতা বাথৌ এর উপাসনায় ছেলে ও মেয়ে উভয়েই বাইসাগু নাচের অনুষ্ঠান করে। খেরাই নাচ প্রধানত মহিলারা নাচে, পুরুষরা বাদ্যযন্ত্র বাজায়। এছাড়া মাছ ধরার উৎসবে জলের ভিতর নারী-পুরুষ উভয়েই ‘নাগুর নৌ’ অনুষ্ঠান করে। এছাড়া মেচ জনজাতি জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় নারী ও পুরুষ জঙ্গলে প্রবেশের আগে ‘ডুং-ফং বাদারি’, ধান চাষ আরম্ভ হওয়ার সময় ‘মাই-জাইনৌ’ নাচের অনুষ্ঠান করে।

গ্রন্থপঞ্জী:

Kiruyu, Kajuyuki. An Outline of the Mech Language-grammar, text and glossary (2005-2007).

Basumatary, Birhas Giri. Boro Dialects of Brahmaputra Valley: A Linguistic Study. 2006.

Mandal, Satyendranath. History and Culture of the Bodos. 2011

Census of India- 2011, 1991.

Grierson, G.A. Linguistic Survey of India, Matilal Banarasidas, 1903.