রাভা ভাষা
অসম রাজ্যের গোয়ালপাড়া, কামরূপ ও দারাং জেলা, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলা, মেঘালয় ও মণিপুর রাজ্য এবং বাংলাদেশ ও নেপালে রাভা জনজাতির মানুষের বসবাস। রাভা জনজাতির প্রাচীনতম বাসস্থান সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশ গবেষক এই ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, এদের নিজস্ব বাসস্থান তিব্বত অঞ্চল থেকে পরিব্রাজনের মাধ্যমে গারো পার্বত্য অঞ্চলের উত্তরাংশে মেঘালয় ও অসমে এদের আগমন ঘটে। পরবর্তীকালে এদের কিছু অংশ মূলত চা শ্রমিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স পার্বত্য এলাকায় স্থানান্ত্রিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্স পার্বত্য অঞ্চল কোচ, রাভা, মেচ, ওঁরাও, মুণ্ডা, টোটো ইত্যাদি বহু উপজাতির বাসভূমি যাদের অধিকাংশ এখনো জঙ্গলকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তিস্তা ও সংকোশ নদীর মধ্যবর্তী ডুয়ার্স অংশে (বৃষ্টিস্নাত অঞ্চল), ও আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাটে টোটো উপজাতির সঙ্গে সন্নিবিষ্ট অবস্থায় রাভা জনজাতির বর্তমান বাসসস্থান। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মির্জা নাথান রচিত পার্শি ইতিহাস ‘বাহারিস্তান-ই-ঘালিবি’ তে রাভা জনজাতির উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে মার্টিন তাঁর ‘History, Antiquity, Topography and Statistics of Eastern India’ (১৮৩৮) বইতে রাভা জনজাতির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পেরেইরা (১৯১১) তাঁর ‘The Rabhas in Census of Assam’ বইতে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী রাভা জনজাতিকে ‘কোচা-রাভা’ শ্রেণিভুক্ত করেছেন।
রায় (২০১৬), রায়, মণ্ডল ও রায় (২০১৩) এর মতে রাভা জনজাতি ইন্দো-মোঙ্গলয়েড শাখার অন্তর্ভুক্ত; বোড়ো শাখার অন্যান্য সদস্য যথা গারো, কাছারি, মেচ, হাজং ইত্যাদি জনজাতির সঙ্গে জাতি, ভাষা ও সমাজগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ওয়াডেল (১৯৯০, ৬৫) এর মতে, রাভারা কাছারি উপজাতির একটি প্রশাখা (offshoot)। পেরিরা (১৯১১, ১৪১) এর মতে এই জনজাতির মানুষের মুখ গোলাকার, চ্যাপ্টা নাক, কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট, ক্ষুদ্রাকৃতি চোখ, দেহের নিম্নাংশ সুগঠিত। রাভা জনজাতির মানুষ ৮টি শ্রেণিতে বিভক্ত, যথা- রংদা, মাইতা, সংগা (কোচা), পাতি, হানা, দাহোলি, বীতোলিয়া এবং তোতলা।
রাভা জনজাতির মানুষের নিজস্ব ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বর্তমান। রাভা ভাষা সিনো-টিবেটিয় ভাষা পরিবারের টিবেটো-বার্মান শাখার অন্তর্গত। গ্রিয়ারসন (১৯৬৭) এবং হ্যালে (১৯৮২,৩৪) এর মতে রাভা ভাষার উৎপত্তি বোড়ো উপশাখা (বোড়ো, মেচ ও ডিমাসা ভাষা এর অন্তর্গত) থেকে নয়, বরং এই ভাষা ওপর উপশাখা- অর্থাৎ গারো উপশাখার অন্তর্গত।এই উপশাখার অন্তর্গত অন্যান্য ভাষাগুলি হলো- মান্য গারো, আবেং, ডাক্কা, আটং, রুগা, কোচ ইত্যাদি। ইউ ভি যোসেফ (২০০৭) রাভা ভাষাকে রবিনস বার্লিং (১৯৮৩ ) প্রবর্তিত ‘Sal languages’ (বোড়ো-গারো এবং পূর্ব-নাগা শ্রেনিভুক্ত ভাষাসমূহ) এর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। রাভা ভাষায় ইনফ্লেকশনাল-অ্যানালিটিকাল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষা গারো, বোড়ো ও কোচ ভাষার সঙ্গে সমসত্ত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। রাভা ভাষার তিনটি ঊপভাষা (variety) বর্তমান- রংদানি, মাইতোরি এবং কোচা। রংদানি ও মাইতোরি উপভাষা মেঘালয়ের গারো পার্বত্য অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়, অপরদিকে কোচা উপভাষার ব্যবহার অসম, উত্তবঙ্গ ও বাংলাদেশে বসবাসকারী রাভারা ব্যবহার করে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে রাভা জনজাতির মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০০০, এদের মধ্যে ৫০০০ জন মাতৃভাষা হিসেবে রাভাভাষা ব্যবহার করত; বাকি ১০০০ জন মাতৃভাষা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা বাংলা ব্যবহার করতো। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা পশ্চিমবঙ্গে রাভা জনজাতির মানুষের সংখ্যা ১৫০১৪ জন। এই জনজাতির মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মাতৃভাষা হিসেবে রাভা উপজাতির নিজস্ব ভাষাটির ব্যবহার ক্রমশ কমছে। প্রসঙ্গত ঊল্লেখযোগ্য, রাভা জনজাতি এবং তাদের ভাষা সমনামে পরিচিত। রাভা ভাষার নিজস্ব কোনো লিপি নেই। রাভা সাহিত্য পরিষদ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে অহমিয়া লিপির সামান্য পরিবর্তন করে রাভা ভাষার লিপি হিসেবে গ্রহণ করে। রাভা ভাষা পরিষদ কর্তৃক ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত লিপি বর্তমানে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হাকাচাম (১৯৯৭) রাভা ভাষাকে ‘ধ্বনিপ্রধান’ (tonal) বলে বর্ণনা করলেও এই বৈশিষ্ট্যটি ক্রমশ প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। রাভা ভাষায় ৬ টি স্বরধ্বনি ও ২২টি ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যবহৃত হয়। প্লেফেয়ার তাঁর ‘The Garo’ (১৯০৯, পাতা ১৬৭) বইতে ‘Comparative vocabulary of Awe, Atong, Ruga, Rabha and Koch Words’ নামক অধ্যায়ে রাভা শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। রাভা ভাষার নিজস্ব শব্দগুলি মূলত টিবেটো-বার্মিজ ভাষা পরিবার থেকে আগত। প্রকৃতি, জীবজন্তু, মানব-দেহাংশ, খাদ্য, সম্বোধন ইতাদি বিষয়ক শব্দগুলি এই ভাষার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বিমূর্ত বিষয় প্রকাশক কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। উদাহরণস্বরূপ- ‘হা’- জল, ‘মায়’-ভাত, ‘আং’-আমি ইত্যাদি। কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলিতে ভাষা পরিবারের প্রভাব দেখা যায় না, এগুলির উৎপত্তি স্ব্যংসম্পূর্ণ ভাবে রাভা ভাষার মধ্য থেকেই ঘটেছে। যথা- ‘চিকা’-জল, ‘চোকো’-মদ, ‘মিংকু’-বিড়াল, ‘টুপু’-সাপ ইত্যাদি। বোড়ো শাখার অন্য ভাষাসমূহের সঙ্গে রাভা ভাষার শব্দভাণ্ডারের প্রভূত সাদৃশ্য থাকলেও কিছু শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তাই এগুলিকে পৃথক শব্দ (separate words) হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। যেমন- ‘কায়’- মানুষ, ‘বায়’- দেবতা, ‘চায়’- গান ইত্যাদি। এছাড়া অসমিয়া ও বাংলা ভাষা থেকে রাভা ভাষায় বেশ কিছু কৃতঋণ শব্দের (loan words) প্রবেশ ঘটেছে; যেমন- ‘পাপ’, সংসার’, ‘সত্য’, ‘রাজা’ ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা বাংলা এবং তরাই-ডুয়ার্স দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ায় এই অঞ্চলের মান্য ভাষা নেপালীর প্রভাব অনস্বীকার্য। রাভা ভাষার নিজস্ব লিপির অভাব ও স্কুলপাঠ্য ভাষার স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে রাভা জনজাতির মানুষজন ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষগুলির ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
গ্রন্থপঞ্জী :
Grierson, G.A. Linguistic Survey of India Vol 3, Part 1. Motilal Banarasidas, 1967.
Hale, Austin. Research on Tibeto-Burman Language. Mouton Publishers, 1982.
Pereira, The Rabhas in Census of Assam, 2011.
Census of India-2001.
Joseph, U.V. RABHA BRILL, 2007.